চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

সর্বশেষ:

বোয়ালখালীতে সড়কই এখন হাট-বাজার

নিজস্ব সংবাদদাতা, বোয়ালখালী

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৩:৪৮ অপরাহ্ণ

গ্রামে দাদুর সাথে হেঁটে হাটে যাওয়া ছোট্ট রুবেল এখন ঢাকার বাসিন্দা। চাকরির সুবাদে তার বোয়ালখালীতে তেমন আসা হয় না। জীবিকার তাগিদেই গ্রাম ছেড়েছেন রুবেল। দাদু নেই, তবে দাদুর সাথে হাটে যাওয়ার স্মৃতি আজও রুবেলের মনে গেঁথে আছে। গত ঈদে রুবেল পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন গ্রামে। নিজের ছেলেমেয়েকে বলছিলেন সেসব দিনের দুরন্তপনা এবং হাটে গিয়ে দাদুর কাছে বায়না ধরার কথা।

 

প্রাচীনকাল থেকে হাট-বাজারগুলো গ্রামীণ ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। সপ্তাহের দু’দিন নিয়ম করে নির্ধারিত স্থানে বসতো এসব হাট। কালের বিবর্তনে অনেক হাট আজ বিলুপ্ত। তেমনি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলীর ঐতিহ্যবাহী লালার হাট, করলডেঙ্গা উত্তর ভূর্ষি গ্রামের কালী শংকর পেশকার হাট, পটিয়া-বোয়ালখালী সীমান্তের হারগাজীর নয়া হাট ও মুকুন্দরাম হাট।

 

এসব হাটে স্বল্প পরিসরে ঘরের আঙিনায় উৎপাদিত শাক-সবজি, সবজির চারা, বীজ, গাছের নারিকেল, সুপারি, মরিচ, পেঁপে, কলা, লাউ-কুমড়ো, কবুতর, হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করে অনেকের সংসার চলতো। ছিল না মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট। ফলে সাশ্রয়ী দামে পণ্য পৌঁছাতো ভোক্তার কাছে। এখন আর এসব খুব একটা দেখা যায় না।

 

পূর্ব গোমদণ্ডী গ্রামের প্রবীণ আবদুল হালিম বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারদের কাছে চলে গেছে কৃষকের উৎপাদিত ফসল। পাইকাররা ক্ষেত থেকেই কিনে নিয়ে যান। ফলে এখন আর কৃষিপণ্য বাজারে নিয়ে দাম যাচাই করার সুযোগ হয়ে ওঠে না কৃষকের।

 

উপজেলার কালাইয়ার হাট এক সময় শন ও ‘গুরাকচু’র ছড়ার জন্য বিখ্যাত ছিল। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার এ হাট বসে। তবে আগের সেই জৌলুস নেই। বোয়ালখালী পৌর এলাকার মুরাদ মুন্সির হাট পান-সুপারি ও বাঁশ-বেতের তৈরি লাই, খাড়াং, কুলা, চালইন, ফেউন্না ও শীতলপাটির জন্য সুপ্রসিদ্ধ ছিল। সপ্তাহের রবিবার ও বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে এই হাট সরগরম হয়ে উঠতো। অনেক দূর থেকে শোনা যেতো হাটের কলরব।

 

মুজাহিদ চৌধুরী পাড়ার বয়োবৃদ্ধ রাজা মিয়া বলেন, আগে স্বল্প পরিসরে ক্ষেত করতাম। ঘরে পালিত হাঁস-মুরগির ডিম, গাছের নারিকেল, সুপারি, বাতাসা মরিচ, শিম, পেঁপে সংগ্রহ করে হাটে নিয়ে বিক্রি করতাম। এছাড়া বাঁশ-বেত দিয়ে ঝুঁড়ি, খাড়াং ও লাই তৈরি করে হাটে নিয়ে যেতাম। এসব বিক্রির অর্থ দিয়ে ঘরের জন্য বাজার করে আনতাম। বাজার বলতে চাল, ডাল, তেল ও মসলাপাতিই ছিল অন্যতম।

 

কৃষক মোহাম্মদ শামসু বলেন, জমিতে উৎপাদিত শাক-সবজি, ফেলন, মুগডাল হাটে বিক্রি করে সংসার ভালোই চলতো। এখন হাট থেকে এসব কিনতে চায় না মানুষ। সব রেডিমেড হয়ে গেছে।

 

উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক-মহাসড়কে, অলিগলিতে এখন বাজার বসছে। হাতের নাগালে সবকিছু পাওয়া যায়। উপজেলার জোটপুকুর পাড়, পৌর সদর, বুড়ি পুকুর পাড় এবং তুলাতল এলাকায় সড়ক-ফুটপাত ও রেললাইনে প্রতিদিনই বাজার বসে। এসব বাজারের কারণে যানজট ও সরকারি হাট ইজারাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে রাসেল নামে এক পথচারী জানান, সড়কই যেন বাজার। হাঁটার জো পর্যন্ত নেই।

 

জানা গেছে, উপজেলার ঐতিহ্যবাহী হাট-বাজারগুলোর মধ্যে শাকপুরার গোলকমুন্সির হাট, চৌমুহনী বাজার, সারোয়াতলীর বেঙ্গুরা বাজার, পোপাদিয়ার চান্দার হাট, অন্নপূর্ণার হাট, চরণদ্বীপের ফকির হাট, শ্রীপুর-খরণদ্বীপের নুরুল্লা মুন্সির হাট, কেরানী বাজার, শান্তির বাজার, আমুচিয়ার কালাইয়ার হাট, শ্যামরায় হাট, করলডেঙ্গার নতুন হাট, পশ্চিম গোমদণ্ডীর জমাদার হাট, পূর্ব গোমদণ্ডী মুরাদ মুন্সির হাট, হাজির হাট, কধুরখীলের চৌধুরী হাট উল্লেখযোগ্য। এখন এসব হাট-বাজারে আগের সেই জৌলুস নেই। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আর এসব বাজারে ছুটে আসে না।

 

পূর্ব গোমদণ্ডী মুরাদ মুন্সি হাটের ষাটোর্ধ্ব হাছি মিয়া বলেন, আগে বাজারবার এলে হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে পণ্য কিনে নিয়ে যেতো।

 

শাকপুরার বাসিন্দা আলী আকবর বলেন, সাপ্তাহিক বাজার করার ফলে অনেক আর্থিক সাশ্রয় এবং অপচয় কম হতো। বিশেষ করে বাড়ির গাছের ফলমূল ও উৎপাদিত কৃষিপণ্য পাওয়া যেতো। এগুলো ছিল বিষমুক্ত ও ভেজালমুক্ত। এখন বাড়ির উৎপাদিত ফসল আর বাজারে পাওয়া যায় না। তখন সরাসরি কৃষক আর ভোক্তার মাঝে লেনদেন হতো। তাই চড়া দাম ছিল না।

 

উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বোয়ালখালীতে ২৫টি হাট ছিল। এর মধ্যে ১৮টি হাটের অস্তিত্ব রয়েছে কাগজে-কলমে। প্রতি বাংলা সনে এসব হাটের ইজারা দিয়ে রাজস্ব পায় সরকার। উপজেলার অন্যান্য হাটে খুব একটা লোক সমাগম নেই। ক্রেতা বিক্রেতার উপস্থিতিও কম। তবে সপ্তাহের রবিবার ও বুধবার জমজমাট হয়ে ওঠে শাকপুরা চৌমুহনী বাজার।

 

আরাকান সড়কের দু’ধারে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে বসে চৌমুহনী বাজার। গত কয়েক বছর ধরে এ বাজার ইাজারা দিয়ে অর্ধকোটি টাকার রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। অন্যান্য বাজারগুলো থেকে নামমাত্র রাজস্ব আসে। এই বাজারে সবকিছুই অন্যান্য বাজারের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায় বলে জানান ক্রেতারা।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট