বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড়ধসের শঙ্কায় বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। প্রতিবছর পাহাড়ধসে বহু প্রাণহানির ঝুঁকিতে মাইকিংও করতে দেখা যায়। তারপরও বন্ধ করা যায়নি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে মানুষের বসবাস। যদিও বর্ষা এলেই এখানে বসবাসরত মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়, তবুও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ এখানে বসবাস করছেন।
১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর পাহাড় দখল করে বসতি স্থাপন শুরু হয়। গ্রামে জনবসতি বৃদ্ধি, নদীভাঙনের শিকার, বসতবাড়ির জমি সংকটের ফলে পাহাড়ধসের ঝুঁকি জেনেও বসতি বেড়েছে কয়েকগুণ। সাধনপুর, চাম্বল, পুকুরিয়া, কালীপুর, পুঁইছড়ি, শীলক‚প জলদি এলাকায় সরকারি পাহাড় কেটে মাটি সমতল করে পাহাড়ের ঢালুতে জমি দখলে নিয়ে বসতবাড়ি তৈরি করে দিনাতিপাত করছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ।
উপজেলা প্রশাসন ও বেসরকারি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি আরও বেড়েছে। উপজেলায় সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন অন্তত ৩০টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে কয়েকশ পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৬টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৮৫টি। সরকারি বন বিভাগের মালিকানাধীন পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার।
বিভিন্ন পাহাড় কেটে প্রশস্ত সড়কের পাশাপাশি লোকালয়ে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। এতে স্থানীয়দের মাঝে বসতি স্থাপনে আগ্রহ বাড়ছে। সরকারি জমি দখল করে গড়া অবৈধ বসতিতে যেন বৈধ সুবিধা মিলছে! দিন দিন অবৈধ দখলদারের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কাজে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে। প্রশাসনের নজরদারির অভাবে প্রতিনিয়ত সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বাড়ছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে রয়েছে অন্তত ৭০ হাজার মানুষ। মৃত্যুঝুঁকি সত্তে¡ও জায়গা ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না বাসিন্দারা।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ও বনবিভাগের কর্মকর্তার সহায়তায় কিছু প্রভাবশালী লোক পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের নিচে ৫-১০ শতক জায়গায় ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে বসতি স্থাপন করার জন্য কিছু স্থানীয় হতদরিদ্র মানুষকে ভাড়া দেয়। ধীরে ধীরে দখল করে জায়গাটি স¤প্রসারণ করে থাকে। কয়েক বছর পর দখল করার জায়গাটি সংস্কার করে কয়েক তলা পাকা দালান করে ফেলে। এভাবেই চলছে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন।
সাধনপুর লটমনি পাহাড়ের ঢালু এলাকায় অবস্থান করা আবুল কাশেম জানান, জায়গাজমি কিছুই নেই। দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। পাহাড়ের ঢালু এলাকায় থাকতে তো ভয় লাগেই। আমরা জানি, ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ধস হতে পারে। কিন্তু আমরা নিরূপায়। আমাদের থাকার কোন জায়গা নেই। তাই ঝুঁকি জেনেও বাধ্য হয়ে থাকতে হয়।
মো. নুরুজ্জামান নামে আরেকজন বলেন, প্রশাসন একবার উচ্ছেদও করে। পরে আবার এখানে ঘর তৈরি করে থাকা শুরু করি। ছয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাই বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে। সরকার আদর্শ গ্রাম গুচ্ছগ্রাম তৈরি করছে। যদি আমাদের পুনর্বাসন করে সেখানে চলে যাবো।
এদিকে, পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, সরকারি সংস্থাগুলো নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলে পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের বসতি বাড়ছেই। প্রশাসন কখনও পাহাড়ে বসতি স্থাপনের মূল হোতাদের চিহ্নিত করেনি। যারা বসতি স্থাপন করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। বর্ষা এলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়। সারাবছর নিষ্ক্রিয় থাকে উপজেলা প্রশাসন।
বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, পাহাড়ে অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে বন বিভাগের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। মামলা হচ্ছে, দখল হওয়া বনভ‚মি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে, তাদের সরাতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে নিরাপদ জায়গা চলে যাওয়ার জন্য আইনি ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জামশেদুল আলম বলেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সতর্ক করতে নিয়মিত প্রচারণা চালানো হয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। দুর্যোগ মুহূর্তে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী লোকজনকে সচেতন করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবসময় নজরদারি রাখা হয়।
পূর্বকোণ/ইব