পাহাড়বেষ্টিত বিস্তৃর্ণ জনপদ মিরসরাই উপজেলা। উপজেলাজুড়ে আঞ্চলিক সড়ক ও পাহাড়ের পাশেই গড়ে উঠেছে ছোট বড় ১৩টি ইটভাটা। ৮০ শতাংশ ইটভাটার প্রধান কাঁচামাল মাটির যোগান আসছে পাহাড়ি মাটি আর তিন ফসলি জমি থেকে। এছাড়া জ্বালানি হিসেবে এখনও বিভিন্ন ইটভাটায় ব্যবহার হচ্ছে পাহাড় থেকে কেটে আনা কাঠ। পাহাড়ি অঞ্চলে ইটভাটা স্থাপনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে জানান গবেষকরা।
এছাড়া এসব এলাকায় ইটভাটা থাকায় বায়ু দূষণের পাশাপাশি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি তাদের। এছাড়া এসব এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ওপর স্বাস্থ্যগত প্রভাবও পড়ছে। এলার্জির সমস্যা ছাড়াও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন অনেকে। এসব ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় হতে পারে- পরিবেশ ঠিক রেখে বিকল্প পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন। মিরসরাই উপজেলায় দিন-রাত সমানতালে চলছে তিন ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার উৎসব। এতে জমির টপসয়েল কেটে ফেলায় জমির উর্বরতা হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলেও কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না মাটি কাটা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভার বিভিন্ন ফসলি জমি থেকে মাটি কাটছে অসাধু লোকজন। মাটি কাটার সাথে জড়িত সবাই রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় এমন কাজ করে যাচ্ছেন। দিনের বেলায় কিছুটা কম কাটলেও সন্ধ্যার পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে মাটি কাটার প্রতিযোগিতা। মাটি বহন করা গাড়ির কারণে অনেক সড়ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, বেশির ভাগ মাটি যাচ্ছে ইটভাটাগুলোতে। ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মাটি কাটছেন কতিপয় ব্যক্তিরা। আবার অনেক জায়গা ভরাট করতে ফসলি জমির মাটি নেওয়া হচ্ছে। এসব মাটি কাটার ফলে আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে আশেপাশের ফসলি জমিগুলো। প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো ফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
দেশে বিভিন্ন আইন, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান থাকা সত্তে¡ও ইটভাটার দৌরাত্ম্য কমছে না। মালিকরা মানছেন না কোনো নিয়মকানুন। ক্রমেই বন উজাড়, কৃষির ক্ষতি ও দেশের ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। এতে ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, কমছে চাষাবাদের জমি ও গাছ। ইটভাটায় কয়লার পাশাপাশি কাঠও পোড়ানো হয়। অথচ কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ। ফসলি জমিতে লোকালয়ে এসব ইটভাটার চিমনির উচ্চতা কোনোটিরই ৬০ ফুটের বেশি নয়। অথচ চিমনি থাকতে হবে ১২০ ফুট লম্বা। ইটের ভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় ওইসব এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। এমনকি আশপাশের গাছ মরে যাচ্ছে। গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাটা মাটি, পানি এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় যে কার্বন মনোঅক্সাইড থাকে তা বাতাসকে যেমন দূষিত করে, তেমনি গাছপালা এবং ফসলের ক্ষতি করে। ইটভাটার বর্জ্যে যে সালফার থাকে তা নদী বা জলাশয়কে দূষিত করে। এর ফলে আশপাশের নদী থেকে মাছসহ সব ধরনের জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইটভাটার আগুনের প্রচণ্ড তাপে ইটভাটার আশপাশের ফসলি জমি নিষ্ফলা হয়ে যায়। আর ইটভাটার কারণে বাতাস দূষিত হওয়ায় মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩তে উল্লেখ আছে, ইটভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি (টপ সয়েল) ব্যবহার করলে প্রথমবারের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের জন্য ভাটা কর্তৃপক্ষকে ২ থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। অনুমোদন না নিয়ে ইটভাটা স্থাপন করলে এক বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
সরেজমিন দেখা যায়, রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে সে সময় ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, ধুম, ওচমানপুর, ইছাখালী, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মঘাদিয়া, সাহেরখালী ও ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন ফসলি জমিকে পুকুর বানানো হচ্ছে। আবাদি জমির ওপরের অংশ এক থেকে দুই ফুট গর্ত করে কাটা হচ্ছে মাটি। কোথাও কোথাও কোমর সমান গর্ত। আর এসব মাটি পিকআপ বোঝাই করে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে।
উপজেলার কাটাছড়া ইউনিয়নের জনৈক বাসিন্দা বলেন, আমাদের ইউনিয়নের বিভিন্ন ফসলি জমি থেকে প্রতিরাতে শত শত ট্রাক ভর্তি করে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাটি কাটার সাথে জড়িত সবাই রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। তাই কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না।
দুর্গাপুর এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, প্রতিরাতে ঘরের পাশ দিয়ে ট্রাক চলাচলের কারণে ঠিকমতো ঘুমানো যায় না। ট্রাক চলাচলের কারণে সড়কও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এগুলো দেখার কেউ নেই।
পূর্বকোণ/ইব