দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সন্দ্বীপে মহাসমারোহে চলছে অবৈধ ইটভাটা। বনভূমি ও কৃষি জমিতে স্থাপন করা এসব ইটভাটার অনুমোদন নেই। এগুলোর প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটি সংগ্রহ করা হয় কৃষি জমি ও সরকারি খাল থেকে। ইট পোড়াতে কয়লার পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে উপকূলীয় বনভূমিতে লাগানো কেওড়া কাঠ। ইট পরিবহনে ব্যবহার করা হয় লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন ট্রাক্টর।
কৃষি জমি চাষের কাজে ব্যবহৃত এসব ট্রাক্টরকে রূপান্তরিত করে মিনি ট্রাকের মতো করে ইটভাটার মাটি ও ইট পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। কোন ধরনের কাগজপত্র না থাকায় এসব ভাটাগুলোতে উৎপাদনের তথ্য গোপন করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এতো অনিয়মের পরও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা জানান, সন্দ্বীপে আগে দুই-তিনটা ইটভাটা ছিল। তখন অতিরিক্ত ইট নদী পথে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আনা হতো। গত দেড় যুগ ধরে ইটের চাহিদা ব্যাপক বাড়তে থাকে। এরপর থেকে সন্দ্বীপে ইট ভাটার পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত বছর এখানে সর্বমোট ১৬টি ইটভাটার হিসেব পাওয়া গেছে। তবে এগুলোর মধ্যে মাত্র একটির পরিবেশ ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স রয়েছে। বাকিগুলোর ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অন্য কোন লাইসেন্স নেই।
সন্দ্বীপে বন ঘেঁষে ইটভাটাগুলো গড়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব ভাটায় জ্বালানি হিসেবে শুরু থেকে বন বিভাগের সৃজন করা কেওড়া কাঠ ব্যবহার করা হতো। প্রথমে এসব কেওড়া কাঠ ভাসান চর থেকে আনা হতো। এখন সেখান থেকে কাঠ আনাতে না পারায় গুপ্তছড়া ঘাটের পাশের বনের গাছ ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ ব্যবহার করা হয়। আগে অভিযান পরিচালনা করে মাঝেমধ্যে বন বিভাগ কিছু পরিমাণ কেওড়া কাঠ আটক করলেও গত কয়েক বছর ধরে নীরব।
বন আইন অমান্য করে প্রায় ১২টি ইটভাটা বন ঘেঁষা সীমানা থেকে শুরু করে বনের এক কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে উঠলেও স্থানীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবৈধ ইটভাটায় সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রায় একযুগ ধরে স›দ্বীপে দায়িত্ব পালন করা উপজেলা বন বিভাগ কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন বলেন, যেহেতু আমাদের বনের কোন ক্ষতি হচ্ছে না সেহেতু এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটি বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ করা হয়। দু’একটা ছাড়া অন্য ভাটাগুলোর নিজস্ব মাটির যোগান না থাকায় তারা আশপাশের কৃষি জমির টপ সয়েল ও সরকারি খালের মাটি ব্যবহার করে। কিছু ভাটাতে আবার জেগে ওঠা চরের মাটি কেটে ব্যবহার করা হয়। এসব বিষয়েও নীরব উপজেলা প্রশাসন।
এসব ইটভাটার চুল্লীর বিষাক্ত ধোঁয়া প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করে চলছে। ভাটার আশপাশের জমির ঊর্বরতা নষ্ট হয়ে পতিত জমিতে পরিণত হয়েছে। পুকুরের মাছে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগবালাই। ধোঁয়ায় দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আশপাশের এলাকার ঘরের টিনের চাল। ইটভাটার তিনশো গজের মধ্যে রাস্তাগুলোতে সবসময় বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। ইটভর্তি ট্রাক সড়কে চলার কারণে টেকসই হচ্ছে না স›দ্বীপের রাস্তা। অবৈধ ও ফিটনেস বিহীন ট্রাক চলাচলের কারণে বেশিরভাগ রাস্তার অবস্থা সংকটাপন্ন।
দিনরাত ইটবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে রাস্তা যেমন টেকসই হচ্ছে না তেমনি বেড়ে যাচ্ছে যানজট। রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ফসলি জমিতে গড়ে তোলা অবৈধ এইসব ইটভাটার কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসলি জমি ও মৎস্য প্রজেক্টের পরিমাণ। এতে কৃষি ফসল ও মাছ উৎপাদন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের সাথে যোগসাজসে প্রতিবছর বেড়ে চলেছে এসব অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা।
গত কয়েকবছর ধরে এসব অবৈধ ইটভাটা ‘ইটভাটা মালিক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতো। বর্তমানে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর তারা নিষ্ক্রিয় হলেও ইটভাটাগুলো চলছে একই কায়দায়।
পূর্বকোণ/ইব