দশ উপজেলা নিয়ে গঠিত দেশের বৃহত্তম জেলা রাঙামাটিতে কয়েক দশকের অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বিনষ্ট হয়েছে বনাঞ্চল, দূষিত হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদের পানি, ঝিরি, ঝর্ণা, সংকট তৈরি হয়েছে বিশুদ্ধ পানির। যা রাঙামাটির জনগণকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে রাঙামাটিতে চালানো এক সমীক্ষাতেও দূষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। দেখা গেছে, রাঙামাটিতে প্রতি মিলিলিটার পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার থেকে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। হ্রদ ঘেরা রাঙামাটির পাহাড়ি অঞ্চল পর্যটকের ভিড় সবসময় লেগে থাকে। তাদের ছুড়ে ফেলা বোতল, চিপসের প্যাকেট, পলিথিন ইত্যাদি আবর্জনায় ভরে থাকে কাপ্তাই হ্রদের পাশাপাশি ঝিরি-ঝর্ণার বিভিন্ন অংশ। অন্যদিকে, গত কয়েক দশক ধরে রাঙামাটি শহর সংলগ্ন হ্রদের ধারে গড়ে ওঠা বসতভিটার হাজার হাজার বাসিন্দারা প্রতিদিন তাদের উন্মুক্ত ও বিভিন্ন প্রকার টয়লেটের পয়ঃবর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা ফেলছে কাপ্তাই হ্রদে। এতে দেশের বৃহত্তম মিটা পানির হ্রদটি যেন ধীরে ধীরে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।
সচেতনতার অভাবে অনেকেই হ্রদের পানিতে প্লাস্টিকের বোতলসহ বিভিন্ন বর্জ্য ফেলছে। এছাড়া পরিবেশের ক্ষতি করছে তা হলো রাঙামাটির কয়েকশত ইঞ্জিন বোটে করে যেসব পর্যটক কাপ্তাই হ্রদে নৌভ্রমণে যায়, তারা খাবার, খাবারের প্যাকেট, পানির প্লাস্টিক বোতল, পলিথিনসহ নানা বর্জ্য কাপ্তাই হ্রদেই ফেলে দিচ্ছে। এছাড়া ইঞ্জিনচালিত নৌকার মবিল, ডিজেলের কারণেও হ্রদের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির অর্থনীতির অন্যতম দিক হচ্ছে কাঠ-গাছের ব্যবসা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-কাঠের কদর রয়েছে। সে কারণে পাহাড়ি কাঠের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। পাহাড়ে উৎপাদিত এসব গাছের বাকল ফেলার পর ড্রেসিং বা গাছের গুঁড়ির উপরি অংশে মসৃণ করে বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। এরপর এসব গাছের কাঠ গুঁড়ি কিংবা টিম্বার হিসেবেই পরিবহন করা হয়। কিন্তু গাছের অংশ বিশেষ ছাঁটাই করে মসৃণ করার ফলে যেসব ড্রাই বা বর্জ্য তৈরি হয় সেগুলো ফেলে রাখা হচ্ছে করাতকলের পাশেই। কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে এসব করাত বা চিরাইকল গড়ে উঠার ফলে গাছের বাকল ও ড্রেসিং করা গাছের অংশ ফেলছে কাপ্তাই হ্রদে। দীর্ঘসময় ধরে এভাবে চলে আসছে। ফলে একদিকে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট হচ্ছে; আরেকদিকে গাছের বাকল-গাছ ছাঁটাইয়ের অংশ বিশেষ পানিতে মিশে দূষণ বাড়াছে হ্রদে পানির।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, প্রায় এক দশক আগেও রান্নার চুলার কাজে কাঠের এসব বর্জ্য অংশ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হলেও বর্তমান সময়ে এসে রান্নার কাজে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ফলে ছাঁটাই করা কাঠের ব্যবহার কমে আসছে। বর্জ্য জাতীয় গাছ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্টদের কোনো নির্দেশনা না থাকায় যত্রতত্রভাবে ফেলা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদে। গাছের বর্জ্য ও কষ (রস) পানিতে মিশে হ্রদে পানি দূষণ করছে। হ্রদে পানি বাড়লে করাতকলের আশপাশের হ্রদের পানি কালচে রঙ ধারণ করে থাকে। এতে হ্রদের মাছের জন্য ঝুঁকি রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
পুরো রাঙামাটি জেলায় এক থেকে দেড় শতাধিক করাতকল রয়েছে; এরমধ্যে অর্ধশতাধিক কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে। বিশেষত রাঙামাটির নানিয়ারচর, সদর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, কাপ্তাই উপজেলার করাতকলগুলো হ্রদ ঘেঁষে। সেগুলোর সবই কাপ্তাই হ্রদের পাশেই। করাত কলগুলোর দূষিত বর্জ্য প্রভাব ফেলছে সরাসরি কাপ্তাই হ্রদে। এতে করে হ্রদের কিছু অংশ ভরাট ও পানির দূষণও হচ্ছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনার সুবিধার্র্থে স’মিল বা করাতকলগুলো কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষেই করা হয়ে থাকে। কাপ্তাই হ্রদের পানি ভরপুর থাকা সময়ে নৌ-পথে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা বোট দিয়ে এসব গাছ মিলে আনা হয়। গাছের ব্যবসা রাঙামাটির গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক দিক। তবে দীর্ঘদিন ধরে করাতকলের ড্রাই বা বর্জ্যগুলো ফেলা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের মধ্যে। এতে করে কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের পাশাপাশি হ্রদের পানির দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। গাছের কষ পানিতে দূষিত করে আসছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, করাতকলের এসব বর্জ্যতো রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ বিষয় নিয়ে কী করা যায় বিষয়টি আমরা ভেবে দেখব।
এদিকে, প্রচলিত গন্তব্যের পাশাপাশি গত কয়েক বছরে রাঙামাটির সাজেক এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণ বাড়ায় অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ শুরু হয়। যদিও এজন্য নেয়া হয়নি কোনো সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা নীতিমালা। অভিযোগ উঠেছে, পর্যাপ্ত পাহাড়ি পর্যটনের অভিজ্ঞতা না নিয়েই সাজেকের পাহাড়গুলোয় বিনিয়োগে আসছেন অনেকে। বিপুলসংখ্যক পর্যটক এলে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কী হবে সেসব বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই, যার কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
এখন ময়লা আর আবর্জনার দূষণ এবং দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত হতে পারছে না একসময় বিশুদ্ধ বাতাসের শহর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাঙামাটি। শহরের বিভিন্ন স্থানে অনেক সময় বর্জ্যে আগুন দেওয়ায় দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত ধোঁয়া প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে। বর্ষায় বৃষ্টির পানিতে মিশে এসব বর্জ্য হ্রদে গিয়ে পড়ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ।
রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির তামাক চাষ। দেশে পার্বত্য অঞ্চলের মতো জটিল ও সংবেদনশীল একটি স্থানের মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানির তামাক চাষ, এখানকার প্রাকৃতিক ঝর্ণা, নদী, হ্রদ ও পাহাড়কে ধ্বংস করছে। ঝিরির পাশে আগে বড় বড় গাছ ছিল। সব কেটে ফেলা হয়েছে। এগুলো পানি সংরক্ষণ করে রাখত। কিন্তু এখন ঝিরিতে পানি আর আগের মতো নেই। হাজার বছরের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক উদ্ভিদ কেটে এক প্রজাতির উদ্ভিদ দিয়ে বনায়নের ফলে ফ্ল্যাশ ফ্লাড, পাহাড়ধস, খরা এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে।
এছাড়া আরো যেসব কারণে প্রকৃতির অপরূপ নন্দনকানন, সবুজ পাহাড়, হ্রদ, অসংখ্য ঝরনা দিয়ে সজ্জিত বৃহত্তর রাঙামাটির ১০টি উপজেলা পরিবেশ, প্রতিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং জীববৈচ্যি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেগুলো হলো :
বনের কাঠ দিয়ে ইটভাটায় আগুন জ্বালানো ও পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে ইট বানানো। তবে এবছর সম্প্রতি রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে অনেক অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এছাড়া রাঙামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি, কাউখালী, রাজস্থলীসহ অন্যান্য উপজেলায় অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। বিভিন্ন সময়ে উন্নয়নের স্বার্থে পাহাড় কেটে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো ও সড়ক নির্মাণ এর ফলেও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
অপরদিকে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় জুম চাষ (একটি ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি চাষ পদ্ধতি) প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। যদিও এটি বনবাসী মানুষের জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, তবে বর্তমান সময়ে জুম চাষ পরিবেশের ওপর বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর প্রধান ক্ষতিকারক দিকগুলো হলো, বন উজাড় ও ভূমি ক্ষয়। জুম চাষের জন্য পাহাড়ি বনাঞ্চল পরিষ্কার করে জমি প্রস্তুত করা হয়। গাছপালা কেটে ফেলার ফলে মাটি ধরে রাখার প্রাকৃতিক ক্ষমতা হ্রাস পায়। মাটি ক্ষয়ে পাহাড়ি নদী ও কাপ্তাই হ্রদে পলিমাটি জমে যায়, যা নদী ও হ্রদের গভীরতা কমিয়ে দিয়েছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায়, যা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে। বন উজাড় হওয়ায় অনেক প্রাণী ও পাখি তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। উদ্ভিদ প্রজাতির ধ্বংসের কারণে স্থানীয় পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে।
এছাড়া গাছপালা কাটায় ভ‚মিধসের ঝুঁকি বেড়েছে। পাহাড়ি ঢালগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। পরে বৃষ্টির পানিতে মাটি দ্রুত ধুয়ে যায়, যা ভূমিধসের কারণ হয়। বর্ষাকালে এটি বিশেষত ভয়াবহ আকার ধারণ করে, মানুষের জীবন ও সম্পদ ঝুঁকিতে পড়ে। কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়।
জুম চাষের কারণে বনের ধ্বংস ও ভূমির ঊর্বরতা হ্রাস স্থানীয় জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে। এতে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যায়। দীর্ঘমেয়াদে খরা ও বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তবে যেহেতু, স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অনেকেই জুম চাষকে ঐতিহ্যের অংশ মনে করে, সেহেতু জুম চাষের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিকে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে রূপান্তর করতে পারলে রাঙামাটির প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব। এজন্য জুমচাষের বিকল্প টেকসই কৃষি পদ্ধতি চালু করতে হবে। কৃষিভিত্তিক ও বননির্ভর পেশার বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে বাংলাদেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে এমন অনেক উন্নয়ন কাজ হচ্ছে যা পরিবেশবান্ধব নয়। এই সব অদূরদর্শী ভুল সিদ্ধান্ত পাহাড়ের পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিবছর পাহাড়ে পানিসংকট হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়টি সমাধানেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এই অবস্থায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ও নীতিনির্ধারকরা মনোযোগী না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
পূর্বকোণ/ইব