প্রায় ৫৮ বছর পরও রাঙামাটি পৌরসভায় গড়ে ওঠেনি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বর্জ্য পরিশোধনে পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বর্জ্যরে ভারে ধুঁকতে হচ্ছে প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভাকে। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে প্রতিদিন ৪০ টন বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের পাশে।
এতে পরিবেশ বির্পয়ের পাশাপাশি রাঙামাটি পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিমপাড়া এলাকায় দুই শতাধিক বসতভিটার লোকজনের দুর্গন্ধের মুখে বসবাস করা দায় হয়ে পড়েছে। সচেতন মহল বলছে, এই স্থানে পরিকল্পিত উপায়ে বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা না থাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যাত্রী এবং পর্যটকদের বর্জ্যরে দুর্গন্ধ সইতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ৬৪.৭৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এবং ১০৬০৬৯ জন জনসংখ্যা অধ্যুষিত রাঙামাটি পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৪০-৪৫ টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়, তন্মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে রাঙামাটি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।
এরপর জমানো বর্জ্য রাঙামাটি পৌরশহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাক, থ্রি হুইলারে করে নেওয়া হয় রাঙামাটি রেডিও স্টেশনের কাছে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্টে বা জৈব সারকারখানা বা ডাম্পিং স্টেশনের নামে পৌরসভা কর্তৃক ক্রয়কৃত রাঙামাটি-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক সংলগ্ন স্থানে। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে রাঙামাটি পৌরসভা কর্তৃক ৩৫ লক্ষ টাকা দিয়ে ৩.৮২ একর আয়তনের জায়গা কিনেছিল। কিন্তু রাঙামাটি পৌরসভার এই ওয়েস্ট ম্যানেজম্যান্ট প্ল্যান্টটি পৌর জনগণের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করেছে বেশি। এটি এখন পর্যটন শহর রাঙামাটিবাসীর গলার কাঁটা হয়ে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে।
রাঙামাটির শহরের প্রবেশমুখে জাতীয় মহাসড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে পৌরসভার বর্জ্য ফেলার এ স্থান অতিক্রম করার সময় চরম দুর্গন্ধে যাত্রী সাধারণ, পর্যটকরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকেই বমি করে ফেলে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটি পৌর শহরের জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে মানুষের ফেলা বর্জ্য আবর্জনার দুর্গন্ধে শ্বাসনালিতে ইনফেকশন হয়ে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। শহরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে নতুন বর্জ্য, বিভিন্ন স্থানে বর্জ্যরে স্তূপের কারণে অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে শহরের পরিবেশ।
উৎকট দুর্গন্ধের তাৎক্ষণিক দুর্ভোগের পাশাপাশি এই দূষিত পরিবেশ এখানকার শিশুসহ সব বয়সী মানুষের জন্য যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সৃষ্টি করছে, তা আরও গুরুতর বিষয়। পর্যটন শহর হিসেবে পরিচিত রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা, সেগুলোর সিংহভাগই গৃহস্থালি ও হোটেল-রেস্তোরাঁর পচনশীল বর্জ্য পদার্থ। সড়কের মোড়ে মোড়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে, বাজার সংলগ্ন জায়গায়, এমনকি লোকজনের বাসাবাড়ির সামনেও দিনের পর দিন সেসব বর্জ্য পড়ে থাকে। উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে; মশা-মাছিসহ নানা রকমের পোকামাকড়ের অবাধ বংশবিস্তার হয়।
এলাকাবসীর অভিযোগ, দুর্গন্ধময় পচা আবর্জনায় ভরা রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে তাঁদের বমি আসে, মাথা ঘোরায়। এমনকি আবর্জনার দুর্গন্ধে বাসা বা দোকানপাটে থাকাও তাঁদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। পাড়া মহল্লা ছাড়াও বাজার এলাকার যেসব স্থানে বর্জ্য বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায় তাহলো, রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি বাজার, কাঠালতলী, বনরূপা, কলেজগেটসহ অন্যান্য স্থানে।
এদিকে বর্তমানে দেশে সরকার পরিবর্তনের পর রাঙামাটি পৌরসভা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নাসরিন সুলতানা পূর্বকোণকে বলেছেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই রাঙামাটি পৌরসভা বর্জ্যমুক্ত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করি। আগে যেখানে দিনে একবার বর্জ্য সংগ্রহ করা হতো, সেখানে বর্তমানে প্রতিদিন কয়েকবার বর্জ্য সংগ্রহ করে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া এলাকার জনগণকে নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য ফেলার জন্য সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের যেখানে বর্জ্য ফেলা হয় সেখানে সড়কের পাশে গ্রিন ফেন্সিং দেওয়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। ফলে এখন রাঙামাটি পৌরসভা আগেরমত অপরিচ্ছন্ন থাকে না।
অপরদিকে, রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া পূর্বকোণকে বলেন, রাঙামাটির সাপছড়ি ইউনিয়নের শুকরছড়িতে রাঙামাটি পৌরসভার জন্য সরকার যে জায়গাটি ক্রয় করেছে বলা হচ্ছে, সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ডাম্পিং স্টেশন হবে না। ঐ স্থানে এডিবির কারিগরি টিম সফর করে জায়গাটিকে ডাম্পিং স্টেশনের জন্য অনুমোদন করেনি। ফলে এখন অন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। ইতোমধ্যে রাঙামাটির আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কের পাশে একটি স্থান পরীক্ষা করা হচ্ছে, যেখানে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা থাকবে, এমন একটি আধুনিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট করা যাবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে এডিবির অর্থ সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই পৌর পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রায় ১২শ কোটি টাকার এই প্রকল্প রাঙামাটি, বান্দরবান ও লামা পৌরসভায় চলছে। রাঙামাটিতে এই প্রকল্পের কাজের মধ্যে রয়েছে পানি শোধনাগার, পুরো রাঙামাটি শহরে নতুন পাইপ লাইন স্থাপন, ওভার হেড ট্যাংক, ওভার গ্রাউন্ড রিজার্ভার স্থাপন। এই প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশটি হলো স্যানিটেশন তথা রাঙামাটি পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থাপন। বান্দরবান ও লামায় জায়গা নির্বাচন হওয়ায় সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু রাঙামাটিতে এখনো জায়গা না পাওয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি শুরু হয়নি।
এদিকে, রাঙামাটি পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটিতে প্রথম ১৯৬৭ সালে শহরবাসীর সেবার জন্য একটি টাউন কমিটি গঠন করা হয়। পরে স্বাধীনতার পর ১৯৭২সালে টাউন কমিটির পরিবর্তে তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত করে রাঙামাটি পৌরসভা গঠিত হয়। পরে ১৯৮৭ সালে রাঙামাটি পৌরসভাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয় এবং ১৯৯৮ সালে রাঙামাটি পৌরসভাকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে ৬৪.৭৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাঙামাটি পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে চুক্তিভিক্তিক কাজ করছেন মোট ১৫৬ জন। তন্মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরাসরি নিয়োজিত আছে ১০৬ জন। এতে পুরুষ ঝাড়ুদার ২১ জন, মহিলা ঝাড়ুদার ৬১ জন। চালক, বিদ্যুৎ, পিয়ন ও গার্ড ৪৬ জন। ট্রাক আছে ৬টি, তন্মধ্যে সচল ৩টি, থ্রি-হুইলার টেক্সিভ্যান আছে ১৫টি, তন্মধ্যে চালু আছে ৫টি। পাকা ডাস্টবিনের সংখ্যা ১৫টি, আবর্জনা সংগ্রহের পয়েন্ট ১১৬টি স্থান।
পৌর এলাকায় বিতরণকৃত ডাস্টবিন (২০ লিটার) ৯০০০ পিস, বিতরণকৃত (১২০ লিটার) ৫০০ পিস। হাটবাজারের সংখ্যা ৮টি। রাঙামাটি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ পৌরবাসীর কাছ থেকে বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে মোট ১৭% শতাংশ ট্যাক্স নিয়ে থাকে। তন্মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স হলো ৭% শতাংশ, সংরক্ষণ হলো ৭% শতাংশ এবং আলোকন বা বিদ্যুৎ বাবদ ৩% শতাংশ। পৌরসভার হিসেবে মোট হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ১৬৯৩৩টি। জানা গেছে, রাঙামাটি পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জন্য ড্রাম ট্রাকসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদির স্বল্পতা রয়েছে।
পূর্বকোণ/ইব