স্কেভেটর দিয়ে কাটা হচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বিনষ্ট হচ্ছে বনাঞ্চল। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে ময়লা-অবর্জনায় দূষিত হচ্ছে নদী, ঝিরি ও ঝর্ণার পানি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদের বুকে প্রতিদিন বাধাহীনভাবে চলছে কয়েকশ ইঞ্জিনচালিত বোট। করাতকল থেকে দিনরাত ভেসে আসছে গাছ কাটার শব্দ।
শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণের এসব কর্মকা- চলছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে। এর ফলে নির্মল রাঙামাটি এখন দূষণের শহরে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা রাঙামাটির ‘নৈসর্গিক রূপে শকুনের থাবা’য় শহরের প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়নযজ্ঞের কারণে দিন দিন বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাঙামাটি।
সীমান্ত সড়কে কাটা পড়েছে ১৬০ পাহাড়: সীমান্ত সড়ক পশ্চাৎপদ পার্বত্যাঞ্চলকে উন্নয়নের ধারায় এনেছে ঠিকই, কিন্তু ক্ষতি হয়েছে পরিবেশের। কেবল রাজস্থলীর সীমান্ত সড়কের জন্যই প্রায় ১৬০টি পাহাড় কাটা হয়েছে। এতে এ অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা। পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নে পরিবেশগত বিপর্যয় এড়িয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
পাহাড়ে অবৈধ বসতি নির্মাণ চলছেই: রাঙামাটি শহরের পাহাড়ে অবৈধ বসতি নির্মাণ চলছেই। ১২টি পাহাড়সহ শহরের ৩১টি স্থান জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহিত করে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে। তবে এসব এলাকায় নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক নতুন ঘর। ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। মূল শহরে বসবাসের জায়গা না পাওয়া লোকজনই ঝুঁকি নিয়ে সেখানে থাকছে।
বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের পর ‘ভূমিধসের কারণ চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ শীর্ষক অনুসন্ধান কমিটি’ স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি বেশকিছু সুপারিশ করে। সুপারিশগুলোর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা রক্ষায় প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ, নতুন করে বসতি স্থাপন বন্ধ করা, পাহাড় কাটা বন্ধ করা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়নি এখনও।
গলার কাঁটা প্রবেশমুখের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: ৫৮ বছরেও রাঙামাটি পৌরসভায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে প্রতিদিন ৪০ টন বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। রাঙামাটি শহরের প্রবেশমুখে জাতীয় মহাসড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে পৌরসভার বর্জ্য ফেলার এ স্থান অতিক্রম করার সময় চরম দুর্গন্ধে যাত্রী সাধারণ ও পর্যটকরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন; বমিও করেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়–য়া বলেন, ডাম্পিং স্টেশনের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। রাঙামাটির আসামবস্তিÑকাপ্তাই সড়কের পাশে একটি স্থান পরীক্ষা করা হচ্ছে। যেখানে একটি আধুনিক ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট করা যাবে। এডিবির অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই পৌর পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পের অধীনে প্ল্যান্টটি নির্মাণ করা হবে।
বসতি বাড়ায় ঝুঁকিতে হাতির আবাসস্থল: চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন কাপ্তাই-কর্ণফুলী রেঞ্জে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। হাতির আক্রমণে গত দশ বছরে কাপ্তাইয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০ জনের। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের অন্তর্ভুক্ত সংরক্ষিত বনাঞ্চল বন্যহাতির নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কিন্ত বসতি বাড়ায় দিন দিন তা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে; ঝুঁকিতে পড়েছে হাতির আবাসস্থল।
বন বিভাগের কাপ্তাই সহকারী বন সংরক্ষক মাসুম আলম জানান, বনাঞ্চলে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বের কারণ হলো- খাদ্য সংকট, চলাচলের জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ, জনবসতি বৃদ্ধি। এসব কারণে হাতি লোকালয়ে এসে তা-ব চালাচ্ছে। হাতি-মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে সোলার ফেন্সি লাইন স্থাপন করা হয়েছে। ৪টি এলিফেন্ট রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে।
দখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি জায়গা: রাঙামাটি শহর ও উপজেলা সদরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে ফেলছে প্রভাবশালীরা। এতে শহরকে পরিকল্পিতভাবে একটি সুন্দর পর্যটননগরী বা পর্যটন হাব হিসেবে গড়তে প্রয়োজনীয় জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ধীরে ধীরে রাঙামাটি ঘিঞ্জি ও অপরিকল্পিত নগরীতে পরিণত হচ্ছে। জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাস টার্মিনাল, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কল্যাণপুরের কিছু এলাকা, কালিন্দিপুরের কিছু এলাকা, হ্যাচারি এলাকা, তবলছড়ির বিভিন্ন এলাকা, রিজার্ভ বাজারের কিছু এলাকা, ভেদভেদীর কিছু এলাকা, আসামবস্তি-রাঙাপানির কিছু এলাকা এবং শহরতলীর মানিকছড়ির কিছু এলাকা দখল করে ফেলেছে প্রভাবশালীরা। এসব উদ্ধারে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই প্রশাসনের।
কাপ্তাই হ্রদের মাছ কমছে: প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ কাপ্তাই হ্রদ দেশের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের পাশাপাশি স্থানীয় লাখো মানুষের আয়-উপার্জনের অন্যতম অবলম্বন মৎস্যশিকার, মৎস্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণও হয় এই হ্রদ ঘিরে। তবে নির্বিচারে মৎস্যশিকারের ফলে মেজর কার্প মাছের মজুত মারাত্মকভাবে কমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা কৌশল উন্নয়নের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদ থেকে প্রতিবছর পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদন সম্ভব। এজন্য কাচকি বা মশারিজাল বন্ধ করতে হবে। প্রজননসময়ে মৎস্যশিকার ছয় মাস বন্ধ রাখতে হবে। পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়া এই মৎস্যপ্রজননক্ষেত্র ও চলাচলের পথ পুনঃখনন করতে হবে।
পূর্বকোণ/পিআর