পার্বত্য চট্টগ্রামে দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে আফ্রিকার কৃষিজ ফসল কাসাভা চাষ। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় ধস ও মাটিক্ষয়ে উর্বরতা হারাচ্ছে শত শত পাহাড়ি টিলা। এছাড়া বন উজাড় করে কাসাভা চাষের কারণে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে।
মৃত্তিকাবিজ্ঞানীরা পাহাড়ে কাসাভা চাষকে জুম চাষের চেয়েও ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঢাকার দুটি বাণিজ্যিক কোম্পানি সুদমুক্ত ঋণসহ সার্বিক সহায়তাদানের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাসাভা চাষে উৎসাহ জোগাচ্ছে গরিব লোকজনকে। অন্যদিকে, ঐ কোম্পানি দুটিই কেবলমাত্র ক্রেতা হওয়ায় তাদের নির্ধারিত দামেই কাসাভা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। ফলে তারা ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। পার্বত্য এলাকায় ঠেংগা আলু নামে অধিক পরিচিত কাসাভা বা শিমুল আলুর চাষাবাদ শুরু হয় ১৫-২০ বছর আগে।
প্রথমদিকে সীমিত আকারে চাষ হলেও দিন দিন ব্যাপকহারে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে কাসাভার চাষ। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি, লক্ষ্ণীছড়ি, গুইমারা, দীঘিনালা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড়ি টিলায় কাসাভার চাষ হচ্ছে। সরকারিভাবে বন্দোবস্তিমূলে পাওয়া ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়ি টিলার বনজঙ্গল কেটে সাফ করে কাসাভা গাছের কাণ্ড ছোট ছোট টুকরো করে রোপণ করা হয়। এর ৭-৮ মাস পর মাটি খুঁড়ে তোলা হয় আলু। এভাবে মাটি উপড়ে আলু তোলার দরুণ বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির স্রোতে টিলাগুলোতে মাটিধসের সৃষ্টি হয়।
জানা যায়, খাগড়াছড়িতে দুটি কোম্পানির আওতায় প্রায় সাত হাজার একর পাহাড়ি টিলায় কাসাভা চাষ হচ্ছে। তন্মধ্যে মাটিরাঙ্গাতেই রয়েছে প্রায় ১৩০০ একর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জান গেছে, ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে খাগড়াছড়িতে কাসাভা চাষ ১৫ হাজার একর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে ঐ কোম্পানির। রাঙামাটি ও বান্দরবানেও কাসাভা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
খাগড়াছড়িতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার আলী ফিরোজ বলেন, পাহাড়ে যে পদ্ধতিতে কাসাভার চাষ হচ্ছে তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। কাসাভার গাছের মূলই আলু হিসেবে ব্যবহার হয়। মাটির অনেক গভীরে থাকা এ মূল তোলার জন্য টিলার মাটি কোদাল দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। এভাবে এলোপাতাড়ি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পুরো টিলার মাটিই আলগা হয়ে পড়ে। বর্ষার সময় অল্প বৃষ্টি হলে সহজেই ধসে পড়ে টিলাগুলোর মাটি।
তিনি বলেন, এছাড়া ভূমির উপরিভাগে থাকা মাটির উর্বর উপাদান বা টপসয়েলও ধসে যায়। ফলে টিলাগুলো হয়ে পড়ে অনুর্বর। এক ইঞ্চি উর্বর মাটি বা টপসয়েল সৃষ্টি হতে ১০০ বছরের মতো সময় লেগে যায়। অথচ এ মূল্যবান উপাদানই নষ্ট করা হচ্ছে কাসাভা চাষের কারণে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মো. বাছেরুল আলম বলেন, সমতল ভ‚মিতে চাষাবাদ করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু পাহাড়ি টিলায় কাসাভা চাষ করায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি জানান, কৃষি বিভাগ এ ব্যাপারে চাষিদের সচেতন করতে উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা যায়, ঢাকার রহমান কেমিক্যালস লি. নামে একটি প্রতিষ্ঠান দেশের সমতল জেলার মতো পার্বত্য এলাকায় সর্বপ্রথম কাসাভার চাষাবাদ শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৪ সাল থেকে অপর একটি কোম্পানিও এ প্রজেক্ট শুরু করে। কাসাভা চাষে কোম্পানি দুটি চাষিদের কাছে অর্থ বিনিয়োগসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করে থাকে। উৎপাদিত কাসাভা নিজেদের নির্ধারিত মূল্যেই চাষিদের কাছ থেকে কিনে নেয় তারা।
চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদিত কাসাভা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কারখানায় পৌঁছানোর পর মণপ্রতি ৪৬০ টাকা হারে দেয়া হয় চাষিদের। একটি কোম্পানির কারখানা হবিগঞ্জের অলিপুর এবং অপরটির কারখানা নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত।
নূরুল আফসার নামে এক চাষি জানান, এক গাড়িতে ১২ মেট্রিক টন কাসাভা হবিগঞ্জে কোম্পানির কারখানায় পৌঁছানোর পর ৪-৫ হাজার টাকাও লাভ হয় না। চাষাবাদ, কেরিং এবং সড়কের লাইন খরচ বাদ দিলে পকেটের লাভের অংশ থাকে অতি নগণ্য। তবুও পেটের ভাত জোগাড় করতে এ আলুর চাষ করা।
জানা যায়, চাষাবাদের খরচ হিসেবে কোম্পানি বিনাসুদে চাহিদামতো অগ্রিম ঋণ সুবিধা দেয়ার কারণে দরিদ্র লোকজন কাসাভা চাষে উৎসাহী হন। মাটিরাঙ্গার এক চাষি বলেন, কাসাভা চাষের জন্য কোম্পানি প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা অগ্রিম দেয়।
খাগড়াছড়ি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সদস্য সচিব মো. ফরিদ মিয়া বলেন, খাগড়াছড়িতে সরকারের বন্দোবস্তি দেওয়া পাহাড়ি টিলাগুলোতেই কাসাভা চাষ হচ্ছে। ফলে বনবিভাগের কিছু করার এখতিয়ার নেই।
তিনি বলেন, বন-জঙ্গল কেটে আগুনে পোড়ানোর পর মাটি কষণ করে পাহাড়গুলোতে কাসাভা চাষ করা হচ্ছে। এতে শত শত পাহাড়ের বন ধ্বংসের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও বিপন্ন হচ্ছে। এককথায় পাহাড়ে কাসাভা চাষের কারণে এ পার্বত্য এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ব্যতীত পাহাড়ে কাসাভা চাষ বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়েও তিনি চিঠি লিখেছেন বলে জানান।
মাটিরাঙ্গার পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগ নামে একটি সংগঠনের প্রধান মাহফুজ আহমেদ রাসেল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাসাভা চাষের দ্রুতবিস্তার উদ্বেগজনক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এখানকার বনাঞ্চল পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তিনি জানান, ক্ষতিকর কাসাভার চাষাবাদ বন্ধ করার দাবিতে বেলা ও তাদের সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হয়। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বিভাগর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ-আবেদন পেশ করা হয়েছে। কিন্তু এর কোন ফল পাওয়া যায়নি।
পূর্বকোণ/ইব