চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সীতাকুণ্ডের সর্বত্র বোমা হয়ে ঘুরছে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার!

সৌমিত্র চক্রবর্তী

১০ মার্চ, ২০২৩ | ১২:১১ অপরাহ্ণ

সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের পর নড়েচড়ে বসেছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এর আগে অক্সিজেন কারখানাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সেফটি প্ল্যান বা ঝুঁকি নির্ণয়ে তেমন কোন পদক্ষেপ না থাকলেও এখন কোন প্রতিষ্ঠানের কি অবস্থা তা খতিয়ে দেখা শুরু হয়েছে। এর ফলে জানা গেছে এখানে ১১টি অক্সিজেন কারখানার মধ্যে ৬টিতেই সেফটি প্ল্যান নেই। শুধু তাই নয়, যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকার সুযোগে অক্সিজেন কারখানা, শিপইয়ার্ড, রি-রোলিং মিলস থেকে গণপরিবহন এমনকি ওয়ার্কশপেও ব্যবহৃত হচ্ছে হাজার হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার। ফলে আবারো ভয়াবহ অঘটনের শঙ্কা রয়েই গেছে।

 

জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্ল্যান্ট, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, রি-রোলিং মিলসসহ চার শতাধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিয়ত অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু আতংকের বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই সিলিন্ডারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা খতিয়ে না দেখেই ব্যবহার করছে। যার ফলে বিভিন্ন সময়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বারবার।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি নতুন সিলিন্ডারের বাজার মূল্য ১৪-১৫ হাজার টাকা। সিলিন্ডারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হলে খুচরা বাজারে সেগুলো বিক্রি হয় প্রতি পিস মাত্র ১৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায়। এর ফলে প্রতিটি সিলিন্ডার বাতিল করলে তাতে মালিকদের লোকসান হয় ১২ হাজার টাকারও বেশি। এভাবে শত কিংবা হাজার পিস সিলিন্ডার বাতিল করতে হলে মালিকদের কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়ে যায়।

 

এ কারণে অনেক মালিক মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের ঝুঁকির কথা বিবেচনায় না এনে যতদিন সম্ভব ততদিন নতুন রং করে ব্যবহার করতে থাকেন। এসময় সিলিন্ডারগুলো বোমায় পরিণত হয়ে স্ফূলিঙ্গের অপেক্ষায় থাকে। একটু বেশি গ্যাসের চাপ কিংবা আগুনের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।

 

অন্যদিকে অল্প সংখ্যক মালিক এত বড় লোকসান মেনে নিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ হিসেবে ১৫০০-২ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিলেও কিছু কিছু ক্রেতা সেগুলোকে কিনে নিয়ে পুনরায় রং করে অক্সিজেন রিফুয়েলিং করে বাজারে, শিল্প কারখানা, শিপইয়ার্ড, ওয়াকশপ ইত্যাদিতে সাপ্লাই করে দেন। এতে যেখানেই এসব সিলিন্ডার ব্যবহৃত হয় সেখানেই বোমায় পরিণত হয়ে ঘুরতে থাকে এবং যেকোন মুহূর্তে ঘটতে পারে বিস্ফোরণ।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সীতাকুণ্ডে এভাবেই মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে এর আগে বারআউলিয়া সাগর উপকূলে ম্যাক স্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, কদমরসুলে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর মালিকানাধীন অক্সিজেন প্ল্যান্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটে। গত বছরের ৪ জুন সোনাইছড়ির বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ঘটে যায় এ উপজেলার স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যাতে ৫০ জনের মৃত্যু ও দুই শতাধিক আহত হন। এর মাত্র ৯ মাসের মধ্যে গত শনিবার একই এলাকার কেশবপুর গ্রামে সীমা অক্সিজেন কারখানায় ঘটে যায় আরেকটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এতে ৭ জনের মৃত্যু ও ২৭ জন আহত হন।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানতে পারেন সীতাকু-ের ১১টি অক্সিজেন কারখানার মধ্যে অনুমোদন আছে। এরমধ্যে মাস্টার অক্সিজেন, আবুল খায়ের মেল্টিং লিমিটেড, কেআর অক্সিজেন লিমিটেড, জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড ও সুবেদার অক্সিজেন লিমিটেড নামক পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সেফটি প্ল্যান অনুমোদন আছে। অন্য ছয়টি কারখানার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন নেই।

 

এ বিষয়ে আবুল খায়ের মেল্টিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ইমরুল কাদের ভূঁইয়া বলেন, তাদের অক্সিজেন কারখানাটি অত্যাধুনিক এবং অটোমেটেড। কোথাও কোন ধরনের ত্রুটি সৃষ্টি হয়নি। কে আর অক্সিজেনের স্বত্বাধিকারী মো. সেকান্দর হোসাইন বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিটি সিলিন্ডার এক একটি বোমায় পরিণত হয়। আমি নিয়মিত টেস্ট করে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের মাথা কেটে বিক্রি করে দিই। যেন ক্রেতা আর ব্যবহার করতে না পারে। জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলমাস শিমুল বলেন, আমরা অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তা দ্বারা প্ল্যান্ট পরিচালনা করি। যাতে কোনরকম দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য সবকিছু আপডেট রাখি।

 

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, এখানে যে অক্সিজেন প্ল্যান্টে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটির সেফটি প্ল্যান অনুমোদন নেই। এখানে ১১টি অক্সিজেন কারখানার মধ্যে ছয়টির সেফটি প্ল্যান অনুমোদন নেই। প্ল্যান বাস্তবায়নে আমরা ব্যবস্থা নেব।

 

চট্টগ্রামের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক এস এম সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, আসলে সিলিন্ডারগুলো বিক্রির সময় মালিকদের সেগুলোকে চার টুকরো করে বিক্রি করার নিয়ম রয়েছে। তাহলে তা আর কোনভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। কেউ পুনরায় ব্যবহার করলে সেটি ভয়ানক হতে পারে। আমরা প্রতিটি কারখানায় গিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।

পূর্বকোণ/একে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট