চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

‘শনির দশা’ কাটছে না সীতাকুণ্ডে!

ইমাম হোসাইন রাজু

৬ মার্চ, ২০২৩ | ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

৪ জুন ২০২২। দিনটি ছিল শনিবার। এদিন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আর বিস্ফোরণের ঘটনায় ঝরে যায় অর্ধশত তাজা প্রাণ। আহতের সংখ্যাও ছাড়িয়ে যায় শতকের ঘর। যাদের মধ্যে এখনো পঙ্গু জীবনযাপন করছেন অনেকে। মাত্র আট মাস না যেতেই গত শনিবার বিএম ডিপো থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সীমা অক্সিজেন কারখানায় ঘটল আরেক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা। এ বিস্ফোরণের ঘটনাতেও প্রাণ হারিয়েছেন ৭ জন। গুরুতর আহত হয়েছেন ২০ জন। যাদের এক তৃতীয়াংশই এখনো শঙ্কামুক্ত নন।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৌগোলিকভাবে সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চল, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় সীতাকুণ্ডে প্রচুর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। কিন্তু এসব কারখানার বড় একটি অংশই শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সীতাকুণ্ডে রাসায়নিকের কারখানা, জাহাজভাঙা শিল্প ও রি-রোলিং মিল কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর ফাঁদ হিসেবে পরিচিত।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- সীতাকুণ্ডের ২৭৩ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মোট ১২৬টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, প্রায় দুই ডজন এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট, তিনটি কন্টেইনার ডিপো এবং ১৫৫টি অন্যান্য ছোট ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই আবাসিক এলাকায়। মাত্র দুটি গ্রামেই ১২টির মতো এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। ফলে গ্রামবাসী তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। বিএম কন্টেইনার ডিপো ও সীমা অক্সিজেন লিমিটেডে বিস্ফোরণ এই শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে জনমনে।

 

পরিবেশ আইনে এসব কারখানা লাল-ক্যাটাগরির শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তার মানে এগুলোতে উচ্চঝুঁকি আছে। এ ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিবেশ ও শ্রম আইনে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা থাকলেও সেগুলো মানার বা মানানোর কারও কোনো গরজ নেই। যার কারণেই বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে এ অঞ্চলে। আর এমন অবস্থা বজায় থাকলে ভবিষ্যতেও ‘শনিরদশা’ পিছু ছাড়বে না সীতাকুণ্ডকে।

 

স্থানীয়রা জানান, গত শনিবার বিকাল চারটা’র কিছু পরেই হঠাৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে সীমা অক্সিজেন লিমিটেড নামে এ কারখানাটিতে। যেখানে উৎপাদিত হতো শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন। আর এসব তরল দাহ্য উৎপাদনে প্রতি শিফটে অন্তত শতাধিক শ্রমিক প্ল্যান্টের ভেতর কাজ করতেন। এর বাইরেও অনেক শ্রমিক কাজ করে থাকেন বলে জানা গেছে।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল, বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সিলিন্ডারের বিস্ফোরিত লোহার টুকরো এক থেকে আধা কিলোমিটার দূরে গিয়েও আঘাত হেনেছে। তাতে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একব্যক্তির শরীরে লোহার টুকরো ঢুকে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দৃষ্টি শক্তিও হারাতে বসেছেন তিন শ্রমিক। শ্রবণশক্তিতেও বাধা হয়েছে অনেকের।

 

জানা যায়, অক্সিজেন কারখানাটি মূলত বাতাস থেকেই অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকে। যা পরবর্তীতে সিলিন্ডারে ভরে তা বিভিন্ন কারখানায় সরবরাহ করা হয়। অনেকেই অভিযোগ- সিলিন্ডারে করে অক্সিজেন সরবরাহ করা হলেও তা সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো না। যদিও কারখানাটির কর্মকর্তাদের দাবি নিয়মিত সিলিন্ডার পরীক্ষাও করা হয়।

 

যদিও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরও গণমাধ্যমকে জানিয়েছে- এক সময় অক্সিজেন কারখানাটিতে ‘ত্রুটি’ পেয়েছিল তারা। যার কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশও প্রদান করা হয়। তবে এরপর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্ট বলতে রাজি নন অধিদপ্তরটির কর্মকর্তারা।

 

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দুর্ঘটনাস্থলে অনেক সিলিন্ডার দেখেছি। অনেক সময় সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষা করা হয় না। বিস্ফোরণের অনেক কারণ থাকতে পারে। তদন্তে তা বোঝা যাবে। তবে সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে আমরা মনে করছি।’

 

এমন পরিস্থিতির জন্য তদারকি সংস্থার ‘গাফেলতিকে’ দায়ী করে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি এডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘মানুষের জীবন এখন মূল্যহীন। দাম খুবই সস্তা। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, সীতাকুণ্ডে যে সংখ্যক কারখানা আছে- তাতে যদি তদারকি সংস্থা সঠিকভাবে মনিটরিং করে, তাহলে এমন ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে নিয়ম-নীতির কিছুই নেই। এখন দুর্ঘটনা ঘটলে সবার ঘুম ভাঙে। কিছুদিন এ নিয়ে হইচই হয়। এরপর সব কিছুই ঠান্ডা হয়ে যায়। যার কারণে অঞ্চলটির সাধারণ মানুষও দুশ্চিন্তায় থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এখন থেকে নিয়মিত পরিদর্শন আর তদারকি করা উচিত। তাহলে কিছুটা হলেও এমন দুর্ঘটনা রোধ হবে।’

পূর্বকোণ/একে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট