চট্টগ্রাম বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০২৩

সর্বশেষ:

৪ মার্চ, ২০২৩ | ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

এম জাহেদ চৌধুরী

ক্ষত-বিক্ষত পাহাড়ের কান্না থামাবে কে

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের ফাঁসিয়াখালী বিট-কাম রিংভং পরীক্ষণ ফাঁড়ি। এই বনবিটটি চকরিয়া উপজেলায়। বিটের আওতাধীন উচিতারবিল এলাকায় রয়েছে অন্তত ৫০টি পাহাড়। গাছগাছালিতে ভরপুর এই পাহাড়গুলোর মধ্যে অন্তত ৪০টি পাহাড়ে পাহাড়খেকোদের থাবা পড়েছে। এতে ক্ষতবিক্ষত এখন সেই পাহাড়গুলো। নারিচ বনের ন্যায় থাকা ছোট-বড় গাছ এখন নেই বললেই চলে।

 

পাহাড় খেকোদের খপ্পরে পড়ে বিলুপ্তির পথে গাছসহ একশত থেকে আড়াই’শ ফুট উঁচু পাহাড়। বিপর্যয়ের মুখে পরিবেশ। ফসলি জমিতে করা যাচ্ছে না চাষাবাদ। এতে এলাকাবাসীর প্রশ্ন সৃষ্টিকর্তার দেয়া পাহাড়ের কান্না থামাবে কে?

 

সরেজমিন ঘুরে ও বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া অভিযোগ মতে, উচিতারবিলের অন্তত ৪০টি পাহাড় কেটে বালু বিক্রি করছে ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে বিশাল একটি সিন্ডিকেট। নেপথ্যে রয়েছে আরও প্রভাবশালী চক্র।

 

বিভিন্ন মেশিনের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ও স্কেভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে বালু বিক্রি চলছে দিন-রাত শতাধিক ট্রাকে। সাথে নিকটস্থ মাতামুহুরী নদীর ভরাট চরও রক্ষা পাচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য থমকে পড়ে পাহাড় খেকোদের কার্যক্রম। ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিম চলে যাওয়া মাত্রই ফের শুরু হয় পাহাড় কাটা। দেখে মনে হয় নদীর বালু উত্তোলন, পাহাড় কাটার উৎসব চলছে যেন। কিন্তু এই উৎসব যে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ সেই ব্যাপারে সচেতন কোন ব্যক্তিও বাদ-প্রতিবাদ করতে পারেন না, জানমালের ক্ষতি হবে শঙ্কায়! বিশেষ করে গত আট মাসের মধ্যে ওই এলাকার পাহাড় বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। দিনে রাতে চলছে পাহাড় নিধন।

 

পাহাড় কাটার উৎসবে স্থানীয় চেয়ারম্যান ছাড়াও আরও ২৭-২৮ জন ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া অভিযোগে প্রকাশ। তবে ওই অভিযোগে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ২১ জনের। চেয়ারম্যানকে প্রধান করে অভিযোগে নাম দেয়া অপর ২০জনের মধ্যে হলেন, মৌলভী গিয়াস উদ্দিন, নাঈমুল হক, নুরুল আলম, শহীদুল ইসলাম, বেলাল উদ্দিন, মনছুর আলম, শহিদুল ইসলাম, এখলাছ উদ্দিন, শাহ আকবর শামীম, মো. হায়দার, গিয়াস উদ্দিন, আলাউদ্দিন, সালাহ উদ্দিন, নেজাম উদ্দিন, তানভির হোসেন রিফাত, মো. মনু, ফরিদুল আলম, শহীদুল ইসলাম ও মনছুর আলম। অপর ৭ জনের নাম অভিযোগে উল্লেখ করা হয়নি।

 

গত ১ মার্চ উচিতারবিল এলাকায় কয়েকজন সাংবাদিক পাহাড়কাটার নিউজ সংগ্রহ করতে যায়। ওইসময় দিনমজুর মো. ইউনুছের সঙ্গে কথা বলে পাহাড়কাটার সংশ্লিষ্টদের নাম জানতে চাইলে ভয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে এড়িয়ে যান। এরপরও সাংবাদিকদের নাম জানিয়েছেন সন্দেহ করে মো. ইসমাইলের ছেলে মো. ইউনুছ (৪০) কে দফায় দফায় পিঠিয়ে আহত করে। ২ মার্চ তাকে ভর্তি করা হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। চিকিৎসারত ইউনুছের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ইউনুছ বলেন, ‘আমি সাংবাদিকদের কোনই কিছু বলিনি। তবুও রাতে শামীম, এখলাছ ও আলাউদ্দিনসহ রাজারবিল এলাকায় চেয়ারম্যান আমাকে ডাকছে বলেই মারধর শুরু করে। পরে একটি গাড়িতে তুলে পরিষদে নিয়ে যায়। পরিস্থিতি ভয়ানক হতে পারে মনে করে আমি দূরে একটি গ্যারেজে আশ্রয় নিই। সেখানে আমাকে দ্বিতীয় দফায় বেধড়ক পিটায়।’

 

আহত ইউনুছের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ৩ মার্চ (গতকাল) তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারে বলে ভয়ে কেউই মুখ খুলে না।

 

উচিতারবিলের পাশাপাশি রাজারবিল এলাকায় পাহাড়ও রক্ষা পাচ্ছে না একই সিন্ডিকেটের খপ্পর  থেকে।

 

পাহাড় কাটার পর সিংগভাগ বালু সরিয়ে নিয়ে পাহাড়ের উঁচু ডালে মেশিন দিয়ে পানি ঢেলে দেয়। যাতে পাহাড় কাটার তরতাজা দৃশ্য পুরনো মনে হয়। এভাবে পাহাড় কেটে বালু বিক্রির মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টায় আয় হয় অন্তত সাড়ে তিন লাখ টাকা। এই টাকার একটি অংশ অনেকের মুখ বন্ধ করতে ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগে প্রকাশ।

 

রাজারবিল ও উচিতারবিল এলাকায় গিয়ে দেখা  গেছে, প্রায় ১০০ একর আয়তনের একটি পাহাড় কাটা হচ্ছে। ২৫০ ফুট উঁচু এ পাহাড়ের অর্ধেকের  বেশি এরই মধ্যে কাটা হয়ে গেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বাকিটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে জানান স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিনের লোকজন পাহাড়টি কাটছে। শুধু এ পাহাড় নয়, চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের উচিতারবিল  মৌজায় সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনে এভাবে অন্তত ১০টি পাহাড় কাটার কাজ চলছে। ২০০  থেকে ৩০০ ফুট উঁচু ও ১০০ থেকে ২০০ একর আয়তনের পাহাড়গুলোর তিনটি এরই মধ্যে সাবাড় হয়ে গেছে। স্থানীয় শহিদুল ইসলাম,  বেলাল উদ্দিন, শামীম, মনছুর আলম ও গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি চক্র পাহাড় কেটে মাটি ও বালু বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বিক্রি করছে। আর পুরো কার্যক্রমটি সমন্বয় করছেন চেয়ারম্যান  হেলাল উদ্দিন।

 

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আলম কবির রাজু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নদী ও পাহাড়ের বালু আবাদী জমির উপর দিয়ে পরিবহন করতে গিয়ে ফাঁসিয়াখালীর অন্তত ৫০ একর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে না। পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটলে আমাদের উপর দুর্দশা নেমে আসবে।

 

ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন বলেন, আমার নেতৃত্বে কোন পাহাড় কাটা হচ্ছে না। অভিযোগসহ সবকিছু আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সাবেক চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ও তার আত্মীয়রা পাহাড় কেটে আমার উপর দায় ছাপাচ্ছে।

 

এ ব্যাপারে সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পরিবেশ ও বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরেজমিন ঘুরে তদন্ত করলে কবে কখন পাহাড় কেটেছে এবং কাটছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সঠিক তথ্য উদঘাটন করে পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে যারা লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

 

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, পাহাড় কাটার ঘটনাটি শুনেছি। অচিরেই তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

এদিকে অভিযোগ পেয়েই পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক ফাইজুল কবির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে গিয়ে চার-পাঁচটি পাহাড় কাটার প্রমাণ পেয়েছি। শুনেছি আরও অন্তত ৪০টি পাহাড় কাটা চলছে। এসব পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। পরিপূর্ণ তথ্যের জন্য আরও কয়েকবার ঘটনাস্থলে  যেতে হবে বলেও জানান তিনি।

 

সম্প্রতি মাতামুহুরী নদীর চর থেকে অবৈধ পন্থায় বালু তোলায় পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যানসহ ১৫ জনকে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য নেন।

 

ঘটনার ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় উচিতারবিল পাহাড়ে আমার নেতৃত্বে ৬ বার ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) রাহাত উজ জামানের নেতৃত্বে ৪ বার অভিযান চালানো হয়। আমি নদীর তীর থেকে দুটি বালু উত্তোলনের মেশিন জব্দ করে ধ্বংস করেছি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) ওই এলাকায় অভিযানে যাই। আমার গাড়ি দেখে পাহাড়ি মাটি বহনকারী দুটি ট্রাক পাহাড়ি পথদিয়ে পার্বত্য উপজেলা লামার দিকে পালিয়ে যায়। ওইসময় একজন লোককে অল্পের জন্য ধরতে পারিনি।

 

তিনি আরও বলেন, চকরিয়ার যেখানেই গাছ কাটা, নদী থেকে বালু উত্তোলন ও পাহাড় কাটা হবে সেখানেই অভিযান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পূর্বকোণ/একে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট