চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সামুদ্রিক শৈবালে ভাগ্য বদল

মো. শিমুল ভূঁইয়া

১ মার্চ, ২০২৩ | ১২:০০ অপরাহ্ণ

সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল যুগ যুগ ধরে একটি বিশাল অর্থনীতির খাত হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। এর বহুবিধ ব্যবহার সি-উইডকে একটি আদর্শ ব্লু ইকোনমিক কম্পোনেন্টের পরিচিতি দিয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও প্রসাধনী শিল্পে, গবেষণায় এবং  কৃষিতে সি-উইড এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বিশ্বব্যাপী এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা থাকায় বর্তমানে বাংলাদেশে সি-উইড এর পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রেজুখালে গত বছর থেকে সি-উইড পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে রেজুখালে সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল চাষের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলমান আছে। এই গবেষণা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ এসোসিয়েশন। অর্থায়ন করছে বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

 

রেজুখালে তিন প্রজাতির সি-উইড চাষ : গ্রেসিলারিয়া লেমনিফরমিস, হিপনিয়া মুসিফরমিস, সারগাসাম ওলিগোসিস্টাম। দুই ধরনের চাষ পদ্ধতিতে (জাল ও লম্বা রশির লাইন পদ্ধতি) সি-উইড উৎপাদিত হচ্ছে। জাল পদ্ধতিতে সি-উইড উৎপাদন বেশি হয়। গ্রেসিলারিয়া লেমনিফরমিসের উৎপাদন জাল ও লম্বা রশিতে অনেক বেশি অন্য দুই প্রজাতির তুলনায়। প্রতি বর্গমিটারে উৎপাদন ৪-৫ কেজি প্রতি ১৫ দিনে। হিপনিয়া মুসিফরমিসের উৎপাদনও ভালো (প্রতি বর্গমিটারে ২-৩ কেজি প্রতি ১৫ দিনে) । সারগাসাম প্রজাতির উৎপাদন খুব কম।

 

সি-উইড চাষে উৎপাদন খরচ খুব কম। ৫ বর্গমিটারের একটি জালের প্লট তৈরি করতে জাল, বাঁশ, ও রশি লাগে। এ মাপের একটি প্লট তৈরিতে ৩৫০-৪০০ টাকা লাগে। প্রতিটি প্লট থেকে প্রতি ১৫ দিনে ১৫-১৮ কেজি সি-উইড উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি কাচা সি-উইড এর বর্তমান বাজারমূল্য ১০০-১২০ টাকা। একটি প্লট থেকে ৫ মাসে ৭৫-৯০ কেজি উৎপাদন করা সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৯০০০-১০৮০০ টাকা। একজন প্রান্তিক কৃষক যদি এমন ১০ টা প্লট করেন তাহলে প্রতি ৫ মাসে ৯০০০০-১০৮০০০ টাকা আয় করা সম্ভব। এখানে অতিরিক্ত কিছু যেমন সার ব্যবহার করতে হয় না। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে। নিয়মিত ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। কেউ যেন প্লটের ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য সব সময় দেখাশোনা করতে হবে। লম্বা ২০ মিটার রশিতে লাইন করে সি-উইড চাষও সফল। ২০ মিটার থেকে কম বেশি করেও চাষ করা যায়। সেটা রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধামত করে চাষ করা ভাল।

 

রেজুখালে সি-উইড চাষে কিছু চ্যালেঞ্জ : জোয়ার ভাটায় পানির ঢেউ অনেক বেশি থাকে যার ফলে সি-উইড বড় হলে স্রোতের সাথে ভেসে যায়। ফলে উৎপাদন কমে যায়। সেডিমেন্টেশন মানসম্মত সি-উইড উৎপাদনের বড় অন্তরায়। এর ফলে অনেক সময় সি-উইড এর কালচার প্লট মাটির নিচে চলে গিয়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এছাড়াও কাদামাটি মিশ্রিত পানির কারণে সি-উইডে কাদামাটি লেগে থাকে। হারমিট নামের কাকড়া সূচালো ব্লেডের মত বাড়ন্ত সি-উইড কেটে ফেলে যার ফলে সি-উইড উৎপাদন কম হয়। বর্তমানে সি-স্ল্যাক ও দেখা গেছে যা সি-উইড চাষের অন্তরায়। এন্টারোমরফা নামক সি-উইড কালচারে ইনবিসিভ প্রজাতি হিসেবে কাজ করে। জানুয়ারির শুরুর দিকে এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চে এদের আদিক্য দেখা যায়। এরা চাষকৃত সি-উইডের সাথে লেগে থেকে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানি পাশের হ্যাচারি থেকে আসে যার ফলে সি-উইড মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি রিসোর্ট থেকে বিভিন্ন বর্জ্য এসে সি-উইড এর উপর এসে পড়ে। যার ফলে সি-উইডের কাক্সিক্ষত কাঙ্খিত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কায়াকিং এর ফলে অনেক সময় নৌকা কালচার করা সি-উইডের উপর উঠিয়ে দেয়। যার ফলে সি-উইড ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়। যেখানে সি-উইড থাকে সেখানে মাছও বেশি থাকে। এর ফলে পাশের জেলেরা সি-উইড এর আশেপাশে বা সি-উইড প্লটের উপর জাল মারে। এতে সি-উইড উৎপাদন কম হয়, অনেক ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়।

 

রেজুখালে সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল চাষ সফলতা পেয়েছে। সি-উইড চাষ করে বর্তমানে ৫ (৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা) জন চাষী সাবলম্বী হয়েছে। জীবিকার জন্য আলাদা কর্মক্ষেত্র পেয়েছে। এভাবে সি-উইড চাষ উপকূলীয় মানুষের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। মহিলারা এ কাজে যুক্ত হয়ে নিজেদের সাবলম্বী করতে পারেন। সি-উইড এর মার্কেটিং চ্যানেল নিয়ে কাজ করতে হবে যেন অভ্যন্তরীণ বাজারে সি-উইড এর ভাল দাম পাওয়া যায়। সি-উইড এর ভাল দাম পেলে প্রান্তিক উপকূলীয় জনগণ সি-উইড চাষে আরো আগ্রহী হবে। এছাড়াও সি-উইড থেকে অ্যাগার ও ক্যারাজিনান পাওয়া যায় যার চাহিদা বিশ্বব্যাপী। অভ্যন্তরীণ বাজারেও এসব কেমিক্যালের বাজার রয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে এবং শৈবাল থেকে এসব মূল্যবান কেমিক্যাল সংগ্রহের জন্য ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে। এতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। সি-উইড বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা সমুদ্র কৃষিতে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে পারে।

লেখক : বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাইন্টিফিক অফিসার

পূর্বকোণ/একে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট