চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ছবি: শরীফ চৌধুরী

ঘাট পারাপারে মরছে মানুষ

নিজস্ব সংবাদদাতা

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:০৫ অপরাহ্ণ

কর্ণফুলী উপজেলার ইছানগর এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন শিপিং ব্যবসায়ী বাহারুল ইসলাম। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়িতে ফেরার জন্য সদরঘাটে আসেন তিনি। ঘাটের জেটি নড়বড়ে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নদীর পাড়ে সাম্পান ভিড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছিল মাঝি। কিন্তু তিনি সাম্পানে ওঠার সময় ঢেউয়ে সাম্পান দোল খেলে ভারসাম্য হারিয়ে তিনি নদীতে পড়ে জোয়ারের স্রোতে তলিয়ে যান। ৩২ ঘণ্টা পর শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এরপর ৪ মাস কেটে গেলেও এখনো নড়বড়ে ঝুঁকিপূণ সদরঘাটের জেটি মেরামত করা হয়নি। শুধু সদরঘাট নয়, এমন করুণ চিত্র কর্ণফুলী নদীর অন্তত ১৫টি ঘাটে। প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মজীবী নারী পুরুষ, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী কর্ণফুলী নদী পারাপারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

 

গত এক দশকে এসব ঘাটে নদী পারাপারের সময় নৌ দুর্ঘটনায় অন্তত ২০ যাত্রী মৃত্যুবরণ করেছেন। বছরের পর বছর জনদুর্ভোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও এ নিয়ে ঘাটগুলোর ইজারা কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কোন বিকার নেই।

 

কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী নদী পারাপারে ১৪টি ঘাট রয়েছে। যেগুলোর একপ্রান্ত কর্ণফুলী উপজেলায় অন্যপ্রান্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সীমানায়। স্থানীয় সরকার নীতিমালা অনুসারে ঘাটগুলোর ইজারা প্রদান ও রক্ষণাবেক্ষণ করা দায়িত্ব চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের। কিন্তু ঘাটগুলো প্রতিবছর বাংলা সন অনুসারে পহেলা বৈশাখ থেকে এক বছরের জন্য ইজারা প্রদান করে চসিক। প্রতিবছর ঘাটগুলো ইজারা দিয়ে চসিক কোটি কোটি টাকা আয় করলেও ঘাট রক্ষণাবেক্ষণে ও নিরাপদ নৌ পারাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনীহা রয়েছে সংস্থাটির। ফলে নদী পারাপারে জনদুর্ভোগ ও দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে।

 

স্থানীয়রা জানান, কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের বাসিন্দাদের লেখাপড়া, জীবনজীবিকা ও নিত্য প্রয়োজনে তাদের কর্ণফুলী উপজেলা সদরে যত না যেতে হয়, তার চেয়ে বেশি যাতায়াত করতে হয় চট্টগ্রাম শহরে। সড়ক পথে শাহ আমানত সেতু হয়ে চট্টগ্রাম নগরীতে যেতে অন্তত ৫-১০ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। এছাড়া কর্ণফুলী থেকে নগরীতে সড়ক পথে যাতায়াতে নেই বাস সার্ভিস। কিন্তু কর্ণফুলী নদী পার হয়ে সহজে ও স্বল্প খরচে চট্টগ্রাম শহরে যাওয়া যায়। ফলে এখানকার দুই লাখ লোকের ভরসা নৌ ঘাটগুলো। তাছাড়া বাসাভাড়া কম হওয়ায় শিল্প কারখানার অনেক শ্রমিক নদী পাড় হয়ে কর্ণফুলী এলাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। এছাড়াও যানজট এড়াতে আশপাশে উপজেলা আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া, চন্দনাইশের লোকজনও এ সব ঘাট হয়ে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করে থাকে। ২০০০ সালের দিকে তৎকালীন সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৫টি খেয়া পারাপারে ঘাটে পাকা জেটি ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেন। এরপর থেকে গত দুই দশকে ঘাটগুলো নড়বড়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠলেও মেরামত করা উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে নদী পারাপারে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ রোগী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বেশি। তাতে প্রায়শঃ ঘটছে প্রাণহানি।

 

সাম্পান মাঝিরা জানান, চসিক-কর্ণফুলী উপজেলা সীমানাধীন ১৪টি ঘাটের মধ্যে চসিক থেকে ইজারা নিয়ে ব্রিজঘাট, সদরঘাট, অভয়মিত্রঘাট ও বাংলাবাজার ঘাটে সমিতির সদস্যভুক্ত সাম্পান মাঝিরা বংশ পরম্পরায় যাত্রী পারাপার করে থাকেন। প্রতিটি সমিতিতে ১০০-২১০ জন সদস্য রয়েছে। প্রতি ট্রিপে ১০-১৫জন যাত্রী নিয়ে ইঞ্জিনচালিত সাম্পানে করে নদী পারাপার করা হয়। ডাঙাচর-সল্টগোলা ঘাট, ১১নং মাতব্বর ঘাট, ১২ নং তিনটিংগা ঘাটসহ অন্যান্য ঘাটে নির্দিষ্ট পেশাজীবী সাম্পান মাঝি নেই। প্রতি বছর চসিক নিয়োগকৃত ঠিকাদারের ব্যবস্থাপনা একটি/দুইট ইঞ্জিনবোটের মাধ্যমে যাত্রী পারাপার করা হয়। ইজারা প্রদান করার পর চসিকের কোন নজরদারি না থাকায় যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েন।

 

ইজারাদার দক্ষ চালক ও পর্যাপ্ত ইঞ্জিনচালিত নৌকার ব্যবস্থা না করে খেয়াল খুশিমত যাত্রী পারাপার করে। সুযোগ পেলে ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করেন। ইজারাদাতা কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদাসীনতা ও ইজারাদারের অতি মুনাফা লাভের মনোভাব ও খামখেয়ালিতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে এ ঘাটগুলো দিয়ে নৌ পারাপার। ফলে হয়রানি ও ভোগান্তি পোহাতে হয় এসব ঘাটে নদী পারাপার হওয়া যাত্রীদের।

 

সরেজমিন কর্ণফুলী উপজেলার ডাঙ্গারচর-সল্টগোলা ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা জেটি ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিকল্প না থাকায় যাত্রীদের বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেটি দিয়ে বোটে ওঠতে হচ্ছে। ভাটার সময় পানি কমে গেলে কাদা মাড়িয়ে যাত্রীদের নৌকায় উঠতে হয়। এ ঘাটে দুইটি ইঞ্জিনচালিত বোটের মাধ্যমে যাত্রী পারাপার করা হয়ে থাকে।

 

জানতে চাইলে ডাঙারচর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আব্বাস উদ্দিন বলেন, ডাঙ্গারচরের ১, ২ ও ৩ ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সড়ক পথে চট্টগ্রাম নগরীতে যেতে অন্তত ১০ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। তাই এ ঘাটটি একমাত্র ভরসা অথচ ব্যস্ততম এই ঘাটে মাত্র দু’টি নৌকা। এক একটি নৌকার ধারণক্ষমতা ২০/২৫ জন হলেও প্রায়শ পারাপার করে ৫০ জনের বেশি। সাথে নৌকায় বোঝাই করা হয় মালামালও। আবার দুপুর বেলা বন্ধ রাখা হয় একটি নৌকা। এ অবস্থায় মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এলাকাবাসীকে নিয়মিত শহরে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে হরহামেশা নৌকাডুবিসহ ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটছে। গত এক দশকে বিভিন্ন সময়ে এ ঘাটে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের ফলে নৌ ডুবিতে ১২ জন স্থানীয় বাসিন্দা প্রাণ হারান। এত দুর্ঘটনা এত প্রাণহানির পরও সিটি কর্পোরেশনের টনক নড়েনি।

 

ইজারালব্ধ অর্থের হিস্যা পরিশোধে অনীহা, স্থায়ী সমাধান চেয়ে মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ উপজেলা পরিষদ। একপ্রান্ত কর্ণফুলী উপজেলা, অন্যপ্রান্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সীমানাধীন কর্ণফুলী নদীর ১৪টি ঘাট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রতিবছর বাংলা সন অনুসারে পহেলা বৈশাখ থেকে এক বছরের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা প্রদান করে। স্থানীয় সরকার নীতিমালা অনুসারে ইজারালব্ধ অর্থ কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ৫০% হারে প্রাপ্য। কিন্তু কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদকে ইজারালব্ধ অর্থের হিস্যা পরিশোধে গড়িমসি করছে চসিক। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাংলা ১৪২৫ সনে উপজেলা পরিষদের ইজারালব্ধ প্রাপ্য ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার মধ্যে দুই চেকে ২০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করে চসিক। এরপর চসিক অবশিষ্ট প্রাপ্যসহ ১৪২৬, ১৪২৭, ১৪২৮ ও ১৪২৯ সনের প্রাপ্য হিস্যার কোন টাকা পরিশোধ করেনি।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ইজারালব্ধ অর্থের ন্যায্য হিস্যা চেয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে বারবার তাগাদা দিয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা প্রাপ্য পরিশোধ করছেন না।

 

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে ইজারালব্ধ অর্থের প্রাপ্য অংশ আদায় ও হস্তান্তরিত ফেরিঘাটের ইজারা ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুসারে ঘাটগুলো ইজারা প্রদানে স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী বলেন, নবগঠিত কর্ণফুলী উপজেলায় নানান সঙ্কট রয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে ভাড়া করা অস্থায়ী কার্যালয়ে উপজেলার সকল কর্মকা- পরিচালিত হয়। কিন্তু ঘাট ইজারালব্ধ অর্থের আমাদের প্রাপ্য হিস্যার কয়েক কোটি টাকা আটকে রেখেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। জেলা প্রশাসনের মিটিংয়ে ডিসি মহোদয়ের কাছে এ বিষয়ে উত্থাপন করলে তিনিও চসিককে চিঠি দেয়। তারপরও কোন সুরাহা করেনি চসিক।

 

উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী আরো বলেন, কর্ণফুলী উপজেলাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য মানুষের চট্টগ্রাম শহরের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম এ ঘাটগুলো। কিন্তু  ঘাটগুলো যাত্রীবান্ধব নয়। চসিকের নজরদারি না থাকায় ইচ্ছেমাফিক ভাড়া আদায় করা হয়। প্রায় সকল ঘাট ব্যবহার অনুপযোগী। বোঝাই করা হয় অতিরিক্ত যাত্রী। এছাড়া বন্দরের বিভিন্ন জাহাজ ও নৌ যানের সাথে ধাক্কা লেগে প্রায় নদী পারাপারে বোটগুলো দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তাতে প্রতিবছরই কর্মমুখী জনগণের সলিল সমাধি ঘটে। ঘাট অনুপযোগী হোক আর দুর্ঘটনায় পড়ে জীবনহানি হোক তাতে সব দায় আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। কিন্তু এ সমস্যা লাঘবে সিটি কর্পোরেশনের কোন ভূমিকা চোখে পড়ে না।

 

তিনি আরো বলেন, নীতিমালা অনুসারে ঘাটগুলো ইজারা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হওয়ার কথা জেলা প্রশাসক। ঘাটগুলো দিয়ে মূলত কর্ণফুলীর জনগণ পারাপার হওয়ায় ঘাটগুলো প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা বেশি। সুতারাং ঘাটগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও ইজারা প্রদানের দায়িত্ব আমাদের হাতে ন্যস্ত করা উচিত।

 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি  ফোন রিসিভ করেননি।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট