চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নীরব জনপদ যেভাবে শিল্পনগর

নিজস্ব সংবাদদাতা

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:০৩ অপরাহ্ণ

কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা থেকে শাহমীরপুর বদলপুরা-কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে যে এলাকাটি একসময় ছিল পরিত্যক্ত, এখন সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক শিল্প কারখানা। এক সময়ের নীরব এই জনপদ হয়ে উঠছে শিল্পনগর। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে এখানকার বিশাল এলাকাজুড়ে শিল্পায়নের সূচনা হলেও সরকার কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়ার পর থেকে যেন শুরু হয়েছে শিল্প বিপ্লব। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন কর্ণফুলী নদীর তীরে এবং সমুদ্র উপকূল জুড়ে।

 

স্থানীয়রা জানান, কর্ণফুলীর ইছানগরে স্বাধীনতা পরবর্তী আমলে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, সরবরাহ ও রপ্তানির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে জাপান সরকারের সহায়তায় গড়ে উঠে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)-মৎস্যবন্দর। ইছানগরে একটি সরকারি ও দুইটি বেসরকারি ড্রাইডক স্থাপিত হয়। শিকলবাহায় ১৯৮৪ সালে স্থাপিত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এরপর থমকে ছিল বিনিয়োগ। স্থাপিত হয়নি কোন শিল্প কারখানা। কর্ণফুলী উপজেলার দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে ১৯৮৯ সালে কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতু চালু হওয়ার পর। শাহ আমানত সেতু চালু হলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা অনেক সহজ হয়ে যায়। নদীপথে সহজ যোগাযোগ, কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া, কারখানার জন্য কম দামে পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া ইত্যাদি কারণে এখানে ছোট-মাঝারি ও ভারী কলকারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় বেসরকারি উদ্যোক্তারা। ’৯০ দশকের শুরুতে রাঙাদিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের বৃহত্তম চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা। ১৯৯৪ সালে কর্ণফুলী সার কারখানা (কাফকো) প্রতিষ্ঠা হওয়ার মধ্য দিয়ে শিল্পএলাকা হিসেবে শহরতলীর এ জনপদের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে অনুমোদন লাভের পর ৯৯ সালে অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করে দেশের প্রথম বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড)। দশক পেরোতেই কর্ণফুলীতে উদ্যোক্তারা গড়ে তোলেন ছোট-মাঝারি ও ভারী মিলে শতাধিক শিল্পকারখানা। তাতে হয়েছে বহু মানুষের কর্মসংস্থান। বদলেছে এখানকার মানুষের জীবনমান। নদীপথে সহজ যোগাযোগ, কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া, কারখানার জন্য কম দামে পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া ইত্যাদি কারণে এখানে এসব কলকারখানা গড়ে উঠছে বলে জানান শিল্পখাতের সংশ্লিষ্টরা।

 

জানতে চাইলে শিল্পোদ্যোক্তা ও ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড পরিচালক লায়ন হাকিম আলী পূর্বকোণকে বলেন, ’কর্ণফুলী নদীর অবকাঠামোগত আর শাহ আমানত সেতুর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কর্ণফুলীতে নানা ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। টানেল নির্মাণের ফলে কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড় ঘিরে বিনিয়োগের নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। কর্ণফুলী এখন বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এটিকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল হবে সেখানে। আর এশিয়ান হাইওয়ে ও নতুন সিল্ক রুট প্রবেশ করবে চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী হয়ে উঠবে অর্থনৈতিক করিডোর।’

 

এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ ও মোস্তফা হাকিম গ্রুপের মতো দেশীয় জায়ান্ট শিল্পগ্রুপগুলো কর্ণফুলীতে নতুন করে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে জায়গা কিনেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তাঁদের কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুরুল আলমের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান মোস্তফা হাকিম গ্রুপের এচইএম স্টিল পুরোদমে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। এ প্রতিষ্ঠানে হাজার কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া নদীর দক্ষিণ পাড়ের তীর ঘেঁষে ইন্ডাস্ট্রিয়াল থিম পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে লুব-রেফ বাংলাদেশ লিমিটেড। যাতে প্রায় ১৫শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে জ্বালানি খাতের এই প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে থিম পার্ক গড়ে তোলায় কর্ণফুলীর জুলধা এলাকায় ৩০ একর জায়গা কিনে ভরাট করেছে। যাতে দেশের সর্বপ্রথম বেইজ অয়েল রিফাইনারি ও বিশেষায়িত বিটুমিন প্ল্যান্ট, এক লাখ টনের একটি ট্যাঙ্ক টার্মিনাল গড়ে তোলা হবে। দেশি কোম্পানি ছাড়াও কর্ণফুলী নদীর তীরে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) প্লান্ট স্থাপনে যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে চায় তুরস্ক। সচিবালয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাথে দেখা করে বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান এই প্রস্তাব দেন। এসব প্রতিষ্ঠান চালু হলে আমূল বদলে যাবে কর্ণফুলী উপজেলা।

 

সম্ভাবনাময় বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের কথা মাথা রেখে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যে কর্ণফুলীকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের আলাদা জোন করা হয়েছে। কর্ণফুলী থানাকে ভেঙে নতুন চারটি থানা করা প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘ভৌগলিকভাবে শিল্পকারখানার জন্য কর্ণফুলী উপজেলা খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কর্ণফুলী যেন পরিকল্পিত শিল্পনগরী হয় সেজন্য স্থানীয় সাংসদ ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি খুবই আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। তাঁর তদারকিতে আমরা মাস্টার প্ল্যান করার উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। সর্বাধুনিক ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপনের কাজ চলছে। কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে ছয় লেনের টানেল সংযোগ সড়ক তৈরি হচ্ছে। এসড়কের সাথে যুক্ত ইউনিয়নের প্রধান সড়কগুলো প্রশস্ত ও শিল্পকারখানার ভারী যানবাহন চলার উপযোগী করে তৈরি করা হচ্ছে। ভূমিমন্ত্রীর আগ্রহে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীসহ একটি প্রকল্প প্রণয়নে কাজ করছি।

 

কর্ণফুলী নদী ও সড়ক পথ সুবিধা কাজে লাগিয়ে আমাদের কর্ণফুলী উপজেলা বৃহৎ  শিল্পনগরী হয়ে উঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।’

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট