চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ছবি: শরীফ চৌধুরী

যানজট-জনজটের বটতলী

নাজিম মুহাম্মদ

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:৩৩ অপরাহ্ণ

লোহাগাড়া উপজেলার প্রধান সমস্যা আমিরাবাদ বটতলী বাস স্টেশন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের গুরুত্বপুর্ণ স্টেশনটিতে নেই কোন নাগরিক সুবিধা। যানজট আর জনজটে নাকাল বটতলী এলাকা। সড়কের দু’পাশে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়ানো বটতলী স্টেশনে ছোট-বড় ২৩ মার্কেটে দোকান রয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি। এর বাইরে সরকারি জমি দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ দখলদারের রাজত্ব। দিনদিন কমছে সড়কের প্রশস্ততা। আধাকিলোমিটারেরও কম জায়গাজুড়ে রয়েছে দূরপাল্লার একাধিক বাস কাউন্টার। বাস,  মিনিবাস, লেগুনা ও সিএনজি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। বটতলী স্টেশনে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয়। কিন্ত সেখানে নেই কোন বাস স্ট্যান্ড কিংবা গণশৌচাগার। সড়কের দু’পাশে দিনদিন বেদখল হবার কারণে দুর্ভোগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের। যানবাহন আর দখলদারের চাপে মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে বটতলী মোটর স্টেশন।

 

লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত লোহাগাড়ার ইতিহাস ঐতিহ্য নামে গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে আরাকান রাজা সুধস্মার (১৬৫২-১৬৮৪) মৃত্যুর পর আরাকান রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ওই সময়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন বোহমং হারিও। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে কংলা প্রু দক্ষিণ চট্টগ্রামের আরাকানের শাসনকর্তার চেয়ারে বসেন। সে সময় আরাকানিরা বঙ্গোপসাগরের উপকূলবাসীদের অত্যাচার করলে মোগল বাহিনী শঙ্খ নদীর দক্ষিণ অংশে অভিযান শুরু করে। অভিযানে নেতৃত্বে দেন দোহাজারী দুর্গের সেনাপতি আধু খাঁ ও তার ছেলে সেনাপতি শের জামাল খাঁ। মোঘল বাহিনীর আক্রমণে আরাকানি বাহিনী পরাজিত হয়ে গভীর অরণ্যে পালিয়ে যায়।  তবে ধারণা করা হয়, সেই সময়  লোহাগাড়ায় উভয় পক্ষের বহু সৈন্য হতাহত হয়। আধু খাঁ পাহাড়ি এলাকায় লোহার দ- গেঁড়ে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। চারদিকে যতদূর পর্যন্ত পতাকাটি দেখা যেত সে পর্যন্ত আধ খাঁ’র বিজয় এলাকার সীমানা ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিজয় স্তম্ভের পাশে স্থাপন করা হয় মোঘল সৈন্যদের গড় (দুর্গ)। এ লোহার দ- ও গড়কে কেন্দ্র করে এলাকাটির নামকরণ করা হয় ‘লোহার গড়’। পরবর্তীতে লোহারগড় পারিমার্জিত হয়ে ‘লোহাগাড়া’ নামকরণ হয়ে বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিক লোহাগাড়ার সদর এলাকাতেই অবস্থিত বটতলী স্টেশন। অবিভক্ত সাতকানিয়ার এ লোহাগাড়া ১৯৮১ সালের ২০ মে আলাদা থানায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৫ সালে উন্নীত হয় উপজেলায়। ঐতিহাসিক এ উপজেলা সদরেই অবস্থিত বটতলী মোটর স্টেশন বা বাস স্টেশন। বটতলীর বুক চিরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক নির্মিত হওয়ায় কালের পরিক্রমায়  বটতলী মোটর স্টেশন রূপ নিয়েছে মহীরুহে। দিনদিন গড়ে উঠছে বিপনী বিতান, প্রসার হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্য। এতে লোহাগাড়ার মানুষের যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং যাতায়াতের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে বটতলী স্টেশন।

 

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও লোহাগাড়ার গুরুত্বপূর্ণ এ স্টেশনটিতে পরিকল্পিতভাবে কোন কিছুই গড়ে উঠেনি। সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য নেই কোন ফুটপাত। সড়কের পাশে যেটুকু খালি জায়গা রয়েছে তা ভাসমান হকারের দখলে চলে গেছে অনেক আগে। যত্রতত্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন যানবাহনের স্ট্যান্ড আর বাস কাউন্টার।

 

লোহাগাড়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এম ইব্রাহিম কবির বলেন, মূল সড়কে দখলমুক্ত ও যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ না হলে বটতলী স্টেশনে নাগরিক সুবিধার উন্নতি হবে না। তবে মুল সড়কের বাইরে স্থায়ী বাস টার্মিনালের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। যত্রতত্র বাস স্ট্যান্ড আর ছোট বড় যানবাহনের ছড়াছড়িতে  দিন দিন বাড়ছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। তবে আরকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা মোহাম্মদ আলী জানান, বটতলী স্টেশনের যানজট দূর করতে হলে নির্মাণ করতে হবে স্থায়ী বাস টার্মিনাল। শুধুমাত্র বাস টার্মিনাল নির্মাণ হলেই মানুষের ভোগান্তি পুরোপুরি কমবে তা কিন্তু নয়। সড়কের দু’পাশ দখল করে থাকা ভাসমান হকার ও অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া না হলে ভোগান্তি কমার কোন সম্ভাবনা নেই।

 

‘নিরাপদ সড়ক চাই’-লোহাগাড়া উপজেলা শাখার সভাপতি মোজাহিদ হোসাইন সাগর বলেন, বটতলী স্টেশনে যানজটের অন্যতম কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে অবহেলা। এছাড়া বাস টার্মিনাল, গণশৌচাগার ও কসাইখানা নির্মাণের কথাও বলেন তিনি।

 

লোহাগাড়া বণিক সমিতির অর্থ সম্পাদক সাত্তার সিকদার বলেন, বটতলী মোটর স্টেশনের যানজট সমস্যায় যাত্রী, সাধারণ জনগণ ও ব্যবসায়ীরা চরম চরম দুর্ভোগে রয়েছে। সিএনজি ট্যাক্সি ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে যানজট সমস্যা আগামীতে আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। বিশেষ করে পৃথক একটি বাস টার্মিনাল স্থাপন জরুরি।

 

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের লোহাগাড়া উপজেলার লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্যস্ততম বটতলী স্টেশন। মাত্র এক কিলোমিটার এলাকায় সড়কের দু’পাশে ছোট বড় ২৩টি মার্কেটের মধ্যে রয়েছে গাজি মার্কেট, চৌধুরী বেস্ট প্লাজা মার্কেট, মোস্তফা সিটি মার্কেট, এ রহমান মার্কেট, সিকদার টাওয়ার, এমদাদিয়া মার্কেট, এম কে টাওয়ার, লিয়াকত মার্কেট, পান মার্কেট, বদিউর রহমান মার্কেট, মোস্তফা মার্কেট, এম রহমান মার্কেট, আবচার মেম্বার মার্কেট, আইস পার্ক, নিউ মার্কেট, কর্ণফুলী সিটি, সুমাইয়া প্লাজা, স্টার সুপার মার্কেট, ফোরকান টাওয়ার, মিনি সুপার মার্কেট, লোহাগাড়া সুপার মার্কেট, লোহাগাড়া শপিং সেন্টার, মোবাইল মার্কেট ও মক্কা টাওয়ার। ২৩ মার্কেটে দোকান সংখ্যা ২৫০০ এর বেশি। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বটতলী স্টেশনে গড়ে উঠেনি কোন বাস টার্মিনাল। অথচ সড়কের পাশেই ফুটপাতে রয়েছে দূরপাল্লার চার ধরনের বাস কাউন্টার। রয়েছে পিক আপ, লেগুনা ও সিএনজি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। যেমন- হোটেল হালাল ডাইন এর সামনে থেকে ছাড়া হয় চট্টগ্রাম অভিমুখী এবং কক্সবাজার অভিমুখী সৌদিয়া পরিবহন। একইভাবে এ রহমান চত্বর থেকে কক্সবাজারমুখী এস আলম, এমদাদিয়া মার্কেট এলাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মিনি সুপার বাস, লেগুনা, পিক আপ ছাড়া হয়। এর বাইরে সড়কের দু’পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য সিএনজি ট্যাক্সি, অবৈধ পিকআপ, থ্রি হুইলার, ব্যাটারি চালিত রিক্সা। এসব যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করছে পৃথক পৃথক সিন্ডিকেট।

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক পূর্বকোণ।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট