চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পেয়ারার উৎপাদন কমেছে এক-পঞ্চমাংশ

নিজস্ব সংবাদদাতা

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:৪০ অপরাহ্ণ

চন্দনাইশের পেয়ারার সুখ্যাতি দেশ ছেড়ে বিশ্ব ছড়িয়েছে। এ পেয়ারাকে বাংলার আপেল নামে খ্যাতি দিয়েছে সাধারণ মানুষ। এখানে উৎপাদিত পেয়ারা এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পটিয়া ও চন্দনাইশে প্রতিবছর ১০ হাজার মেট্রিক টন পেয়ার উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তবে বিগত ৫ বছর ধরে অতিরিক্ত ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে উৎপাদন কমেছে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন অর্থাৎ এক-পঞ্চমাংশ। ইট ভাটার দূষিত ধোঁয়ায় পেয়ারার আকৃতি ছোট হওয়ার পাশাপাশি রংও নষ্ট হচ্ছে। চন্দনাইশের পাহাড়ি এলাকায় ৯শ’ হেক্টর জমিতে ৫ হাজারের বেশি ছোট-বড় বাগানে পেয়ারা চাষ হয়।

 

চন্দনাইশের কাঞ্চননগর ও হাশিমপুরের পেয়ারা স্বাদে গুণে ভরপুর। কীটনাশকমুক্ত ও সুস্বাদু চন্দনাইশের কাঞ্চননগরের পেয়ারা। খেতে সুমিষ্ট হওয়ায় পেয়ারার সুনাম রয়েছে। সম্ভাবনাময় পাহাড়ি পেয়ারা চাষে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে হাজারো মানুষের। সংরক্ষণাগার নির্মাণ করে বিদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা করলে আয় করা যেতো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। মৌসুমে প্রতিদিন সকালে কাঁধে ভাঁড় নিয়ে ছুটেন চাষিরা। লাল কাপড়ে মোড়ানো একেকটি পুটলির ভেতরে রয়েছে সুস্বাদু পাহাড়ি পেয়ারা। ভোরের আলো ফোটার আগেই দল বেঁধে পাহাড়ে গিয়ে এসব পেয়ারা সংগ্রহ করেন চাষিরা। এর আগে পেয়ারার গ্রাম নামে খ্যাত কাঞ্চনগরের পাহাড়ের বাগান থেকে ছেঁড়া হয় ফল। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে নানা আকার আর রঙের পেয়ারা। পরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ের পটিয়া ও চন্দনাইশের কাঞ্চননগর, রওশনহাাট ও বাগিচাহাটসহ ১৬টি হাটে তোলা হয় দেশীয় এ ফল। ৬ জাতের সবুজ ও হলুদ পেয়ারা সাজিয়ে রাখা হয় বিক্রির জন্য। যা বদলে দিচ্ছে হাজারো কৃষকের জীবন।

 

দেখতে সুন্দর, খেতে মিষ্টি আর ভিটামিন সি’সহ নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ  এসব  পেয়ারা। পাহাড়ে প্রচুর বৃষ্টির কারণে গোড়ায় পলি জমে। তাই রাসায়নিক কিংবা কীটনাশক ছিটাতে হয় না।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পটিয়া ও চন্দনাইশে প্রতিবছর ১০ হাজার মেট্রিক টন পেয়ার উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। চন্দনাইশ পটিয়ার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের নানা পাহাড়ের ৯শ’ হেক্টর জমিতে ৫ হাজারের বেশি ছোট বড় বাগানে পেয়ারা হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশের পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতি বছর ব্যাপক পেয়ারার ফলন হয়। উৎপাদন পরবর্তী চলে বিক্রির মহোৎসব। উপজেলার জমির মালিক ও ভূমিহীন অনেক কৃষাণ-কৃষাণির মুখে মৌসুমে দেখা যায় হাসির আভা। আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসে এ সকল এলাকার পেয়ারা চাষীদের। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার কাঞ্চননগর, লর্ড এলাহাবাদ, হাশিমপুর, জঙ্গল হাশিমপুর, জামিরজুরী, ধোপাছড়ি, পার্শ্ববর্তী পটিয়ার খরনা এলাকার পেয়ারা বাগানের গাছে গাছে প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে প্রচুর ফলন হয়। তাছাড়া বছরে বার মাসই কোন না কোন গাছে পেয়ারা উৎপাদন হয়ে থাকে। সে সাথে এ পাহাড়ি এলাকায় ব্যাপক লেবুর ফলনও হয়। প্রতিটি গাছে ঝুলে থাকা থোকাই থোকাই পেয়ারা পাহাড়কে ভিন্নরূপে সাজিয়ে রাখে। সবুজ পাতার ঢালগুলো যেন রঙিন পেয়ারার ভারে হেলে পড়ে। এসব এলাকার অসংখ্য মানুষ পেয়ারা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন প্রতি মৌসুমে। সে সাথে এলাকার বেকার যুব সমাজ পেয়ারা চাষে জড়িয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠছে। এভাবে চলে প্রতিবছর তিন মাস। পেয়ারা চাষ সৌভাগ্যের যাদু লাগিয়ে দিয়ে যায় চন্দনাইশের প্রায় ২০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকায়। কিন্তু বিপণন ও প্রক্রিয়াজাত করণের সমস্যার কারণে তথা কোল্ড স্টোরেজ না থাকায় উৎপাদিত পেয়ারার ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় কৃষকরা। চন্দনাইশের মত এত সুস্বাদু পেয়ারা বাংলাদেশের আর কোথাও উৎপাদন হয় না। কাঞ্চন পেয়ারা খুবই সুস্বাদু। বিশেষজ্ঞদের মতে এখানে একটি ফুড ফুডস ফিজারবেন প্ল্যান কমপ্লেক্স করা গেলে মাল্টিজুস এবং জেলি বিক্রির শিল্প কারখানা করা সম্ভব হবে। এতে করে ব্যবসায়ী ও কৃষকরা উপকৃত হবে। উপজেলার কাঞ্চননগর, হাশিমপুর, ছৈয়দাবাদ, লর্ট এলাহাবাদ, পূর্ব এলাহাবাদ, দোহাজারী, রায়জোয়ারা, লালুটিয়া, ধোপাছড়ির ৩০ কিলোমিটার এলাকায় ২০ হাজারেরও বেশি বাগানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পেয়ারা চাষ হয়। এছাড়া গেরস্থির বাড়ি ভিটা, চন্দনাইশের শঙ্খনদী, পটিয়ার শ্রীমাই, খরনা খালের দুই তীর ঘেঁষে ব্যাপক পেয়ারা উৎপাদন হয়। শ্রমিকেরা রাত ৩ টায় পেয়ারা সংগ্রহের জন্য পাহাড়ি বাগানে রওনা দেয়। দেড় থেকে ২ ঘণ্টাকাল পেয়ারা সংগ্রহের পর কাঁধে পেয়ারার ভাড় নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টাকাল পায়ে হেঁটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের এসে পেয়ারা বিক্রি করে। এ জন্য প্রতিজন শ্রমিক পারিশ্রমিক পায় ৫শ থেকে ৬শ টাকা। মৌসুমে প্রতি ভাড় পেয়ারার দাম ১২শ টাকা থেকে প্রকার বেঁধে ১৬শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। গুণগত মানে চন্দনাইশে ১৩ রকমের পেয়ারা উৎপাদিত হয়। তৎমধ্যে দুই ধরনের পেয়ারা খুবই পরিচিত এবং সুস্বাদু।

 

চন্দনাইশের কাজী পেয়ারা ও কাঞ্চন পেয়ারার সুনাম দেশব্যাপী। কাঞ্চন পেয়ারা সর্বোচ্চ ১ কেজি ও সর্বনিম্ন ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রকৃতিগত কারণে পেয়ারার স্বাদ সুমিষ্ট, ঘ্রাণ মোহনীয়, দেখতে খুব সুন্দর। অনেকেই এ পেয়ারাগুলোকে দেশীয় আপেল বলে থাকে।

 

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চন্দনাইশ উপজেলায় ১ হাজার, পটিয়ায় ১ হাজার ৪শ একর পাহাড়ি এলাকা ও সমতল ভূমিতে পেয়ারা চাষ হয়ে থাকে। বেসরকারিভাবে তা ৩ হাজার একরেরও বেশি। চন্দনাইশ ও পটিয়ায় ২০ হাজারের অধিক বাগান রয়েছে বলে চাষীরা জানান। এসব এলাকায় উৎপাদিত পেয়ারা বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট কোন জায়গা না থাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে রওশনহাট, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল গেট, বাদামতল, বাগিচাহাট, খানহাট রেলওয়ে স্টেশন, খরনা রাস্তার মাথাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবছর আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে উৎপাদিত পেয়ারা। মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে পেয়ারার ফলনে বিভিন্ন সময়ে বিপর্যয় ঘটে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা।

সে কারণে বছর ভেদে পেয়ারার দামও বেড়ে যায়। প্রতি মৌসুমে দৈনিক কয়েক হাজার ভার পেয়ারা চন্দনাইশের পাহাড়ি এলাকা থেকে এনে বিক্রয় করে থাকে কৃষকরা। চটগ্রাম-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, চন্দনাইশের কাঞ্চন পেয়ারার সুখ্যাতি সারা বিশ্বে। এ পেয়ারা এলাকার চাহিদা মিটিয়ে পুরো চট্টগ্রামের মানুষ পাচ্ছে। সরকারিভাবে পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।

 

কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার বলেছেন, এ এলাকার পেয়ারা খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। তাই এ এলাকার পেয়ারার চাহিদা প্রচুর। চন্দনাইশের বিশাল পাহাড়ি এলাকা জুড়ে প্রতি বছর মৌসুমে প্রচুর পেয়ারা উৎপাদিত হয়। পেয়ারার জন্য প্রসেসিং সেন্টার থাকলে চন্দনাইশের পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদ আরও বৃদ্ধি পেত। সে সাথে পুরো পাহাড়ি এলাকা ফল বাগান হিসেবে ব্যবহার করা যেত।

 

চন্দনাইশ সমিতি-চট্টগ্রামের সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী বলেছেন, পেয়ারা পচন জাতীয় পণ্য। এটি ৫-৬ ঘণ্টার বেশি রাখলে নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া পাকা পেয়ারা বেশিক্ষণ না থাকার কারণে বাগানিরা বাগানে ফেলে দেয়। এ সকল পাকা পেয়ারা গোয়াবা জেলি তৈরি করলে পাকা পেয়ারাগুলো নষ্ট হতো না।

 

তিনি বলেন, কাঞ্চননগরে রেলওয়ের ওয়ার্কসপের বিশাল জায়গা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ জায়গায় সরকারিভাবে গোয়াবা জেলি তৈরির কারখানা নির্মাণ করলে সরকারের বিশাল রাজস্ব আদায় হতো। সে সাথে রেল মন্ত্রণালয়ের জায়গাটি ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি হতো। ফলে বিশাল একটি জনসংখ্যার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হত। সে সাথে একটি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করে পেয়ারা, লেবু, আনারস’সহ পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত মালামাল রাখার সুযোগ সৃষ্টি হত। ভোর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া থেকে চন্দনাইশের অন্তত সাত জায়গায় বসে পেয়ারার হাট। কমলা আকৃতির সবুজ-হলুদ রঙের এ পেয়ারা কোন জায়গার জিজ্ঞেস করলে যে কেউ উত্তর দেবে, চন্দনাইশ কাঞ্চননগরের। সারা দেশের মধ্যে নামকরা পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারা। মিষ্টি বেশি, বিচির ঘনত্ব তুলনামূলক কম। পাকলে ভেতরে কোনোটি সাদা, কোনোটি হলুদ, কোনোটি লালচে।

 

এখানকার পেয়ারার স্বাদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে পটিয়া চাবাগান স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক সুজা আল মামুন আঞ্চলিক গানের শিল্পী সঞ্জিত আচার্য ও শেফালী ঘোষের ‘গয়াম ভাল পটিয়ার, তরমুজ ভাল পতেঙ্গার’ গানটি স্মরণ করিয়ে দেন। আর সাধারণ পেয়ারাচাষি চন্দনাইশের কাঞ্চননগরের আইয়ুব আলী বললেন, এ পেয়ারার এতই স্বাদ যে, দেশের কোনো পেয়ারার সঙ্গে এর মিল নেই। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পেয়ারার হাট বসে চন্দনাইশের রৌশন হাটে। মহাসড়কের দু’পাশজুড়ে লাল কাপড় বাঁধা পেয়ারার সারি সারি ভার নিয়ে বসে থাকেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, প্রতিদিন পাঁচশ ভার পেয়ারা বিক্রি হয় এ বাজারে। এখানকার পেয়ারা চট্টগ্রাম নগর, কক্সবাজার, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, হাটহাজারী, বাঁশখালী, লোহাগাড়া, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান। পটিয়ার পাহাড়ি এলাকার হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা এবং চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর থেকে দোহাজারী এলাকার কাঞ্চননগর, হাসিমপুর ও জামিজুরী ইউনিয়নের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষের পেয়ারাবাগান রয়েছে। পেয়ারাই তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস। চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকার প্রবীণ বাগান মালিক আইয়ুব আলী খান (৬৫)। ১৯৬০ সালের দিকে দক্ষিণ শ্রীমাই এলাকায় মাত্র ১০ একর জায়গায় পেয়ারাবাগান শুরু করেন তাঁর বাবা মরহুম খলিলুর রহমান। ১৯৮০ সাল থেকে তিনিসহ তাঁর ভাইয়েরা মিলে বাগান বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে পাঁচ ভাইয়ের ৪০ একর পেয়ারাবাগান রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, ১৮৫০ সালের দিকে পটিয়ার কচুয়াই চা বাগানের মালিক হেগিন্স লন্ডন থেকে প্রথমে আনারস, পরে পেয়ারা ও লিচু বীজ এনে তাঁর বাংলোর আশপাশে রোপণ করেন। পরে ওই বীজ থেকে চারদিকে বাগান ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়ভাবে পেয়ারাকে কেউ ‘গয়াম’, কেউ ‘গোয়াছি’ বলে।

লেখক : নিজস্ব সংবাদদাতা, চন্দনাইশ

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট