চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে আছে জোয়ারা পাগলাগারদ

নিজস্ব সংবাদদাতা

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:২৮ অপরাহ্ণ

শত প্রতিকূলতা ও রোগী সংকটের মাঝেও টিকে আছে চন্দনাইশের ঐতিহ্যবাহী জোয়ারা পাগলাগারদ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বদুরপাড়া রাস্তার মাথা থেকে এক কিলোমিটার ভিতরে জোয়ারা গ্রামেই ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের একমাত্র আয়ুর্বেদিক পাগলা গারদটি।

 

কবিরাজ গিরিন্দ্র চন্দ্র দাশ তার নিজ বাড়িতে প্রায় ১০ একর জমির উপর সরকারি অনুমোদন নিয়েই সে সময় ‘কমলা ঔষধালয়’ নিয়ে একটি আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান ও তৎসংলগ্ন পাগলা গারদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে এ প্রতিষ্ঠান নিশি বৈদ্যের বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সম্পূর্ণ মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ আয়ুর্বেদিক এ হাসপাতালটি এখনো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

 

দীর্ঘ ১৪৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে এখনো পর্যন্ত বাইরের কোন ঔষধ ব্যবহার করা হয় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্পূর্ণ নিজস্ব উপায়ে প্রস্তুতকৃত আয়ুর্বেদিক ঔষধের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা করা হয় এ হাসপাতালে। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে শাখা স্থাপন করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসলেও স্বাধীনতার পর তা বন্ধ করে দিতে হয় বিভিন্ন কারণে।

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এখানকার সমস্ত জিনিসপত্র লুঠপাট করে নিয়ে যায় কিছু দুস্কৃতকারী। নিশি বৈদ্যের গড়ে তোলা পাগলা গারদের আসবাবপত্র ভাংচুর করে, কবিরাজী ঔষধ ধ্বংস করে, নিশি বৈদ্যের গড়া কবিরাজী ঔষধখানা ও পাগলা গারদ ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিশি বৈদ্যের পাগলা গারদ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ধার-কর্জ করে পুনরায় এ মানসিক হাসপাতাল চালু করা হলেও তার পূর্ণাঙ্গ রূপ ফিরে পায়নি।

 

ফলে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীরা। তারপরও নিশি বৈদ্য বাড়ির ঐতিহ্য বজায় রাখতে গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছিলেন কবিরাজ অনুতোষ দাশ। এ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ২টি বিশাল আয়তনের পুরাতন মাটির ঘর। ঘর দুটিতে ছোট ছোট জানালা বিশিষ্ট কক্ষ করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষে শিকল আর গাছের বেড়ি স্থাপন করা হয়েছে। যেগুলো মানসিক রোগীদের বেঁধে রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১৬টি ছোট ছোট কক্ষের মধ্যে ২ জন মহিলা, ৪ জন পুরুষ মানসিক রোগী রয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার রচনা দাশ (৪৫), মো. ইউনুছ (৫৮), পটিয়ার ছেমন আরা বেগম (৫০), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার রিমেল বনিক (২০), রাউজান কাগতিয়ার ইফতেখার উদ্দিন (৬৫) ও হাটহাজারী ফতেয়াবাদের বাবু ধর (৫০) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।  এ সকল রোগীদের শিকল দিয়ে বেঁধে তাদের তৈরি করা বেড়িতে পা আটকিয়ে রাখা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা না থাকলেও এখানকার রোগীদের থাকা-খাওয়া, নাওয়া ইত্যাদি সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হয় কেয়ারটেকারের মাধ্যমে।

 

স্বাধীনতার পর থেকে এখানে দুই সহ¯্রাধিক মানসিক রোগীকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ করে তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চিকিৎসা সেবা এ প্রতিষ্ঠানের আওতার বাইরে চলে গেলে তখন রোগীদের পাবনা মানসিক হাসপাতালে অথবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয় বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কবিরাজ সুধীর সেন (৫৮)। তার মতে প্রতিষ্ঠানটি চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি সরকারি সহায়তা না থাকায় বিভিন্ন প্রতিকুল সমস্যা নিয়ে এখনো  খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।

 

চন্দনাইশ পৌরসভার জোয়ারা গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের এ দ্বিতীয় পাগলা গারদ আজ বিলুপ্তির পথে। আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহ্যবাহী নিশি বৈদ্যের এ পাগলা গারদ প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অবহেলিত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে আসা মানসিক রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন এ প্রতিষ্ঠানের লোকজন। সেবা-যতেœর ফলে নতুন জীবন ফিরে পায় তারা। কতিপয় অসাধু ব্যক্তি, প্রশাসনিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মানসিক ভারসাম্য হারানো মানুষেরা সেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। অযোগ্য হয়ে পড়েছে এ পাগলা গারদটি। মানসিক ভারসাম্য হারানো রোগীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের দুঃখের সীমা থাকে না। সবুজ ঘাস ও গাছের লতা-পাতা দিয়ে তৈরি করে থাকে কবিরাজী ঔষধ।

 

নিশি চন্দ্র দাশ প্রকাশ নিশি বৈদ্য তাঁরই দুই সন্তান জীব রঞ্জন দাশ ও চিত্তরঞ্জন দাশের নামে আরো ২টি প্রতিষ্ঠান কমলা ও দামোদর ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যা নিশি বৈদ্যের পরবর্তী বংশধরগণ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের একমাত্র আয়ুর্বেদিক পাগলা গারদটি বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সুধীর সেন জানালেন, তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বৃক্ষ, গুলা, লতাপাতা ও বিভিন্ন ঔষধি দ্রব্যের সাহায্যে প্রস্তুতকৃত ঔষধ এখানকার ভর্তি হওয়া মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এলোপ্যাথিক বা অন্য কোন ঔষধ তারা রোগীকে দেন না। সম্পূর্ণ কবিরাজী পদ্ধতিতে এদেরকে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। তার মতে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া রোগীদের সুস্থ হওয়ার রেকর্ড শতকরা ৮০ ভাগ। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটি চালু হওয়ার পর থেকে একজন রোগীও মারা যায়নি বলে তিনি দাবি করেন।

 

আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কোন ব্যবস্থা না থাকা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, সরকারিভাবে বা কোন ব্যাংক অথবা দাতা সংস্থা থেকে তাদেরকে কখনও কোন সাহায্য দেয়া হয়নি। তাই আর্থিক টানাপোড়নের কারণে ইচ্ছা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। এ পাগলা গারদে ভর্তি করিয়ে কেউ কেউ রোগীর ভরনপোষণের খরচ চালায়, আবার অনেকে খবর পর্যন্ত নেয় না। রোগীদের ঔষধ প্রদান, খাবার বিতরণ চলে নিয়মিত।

 

বদ্ধ উন্মাদ রোগীদের দীর্ঘদিন ধরে এখানে রেখে তাদের অভিভাবকেরা খরচ চালায়। আবার কেউ কেউ মাসিক ভিত্তিতে খরচ দেয়। রোগীরা চিকিৎসা সেবার আওতার বহির্ভূত হয়ে গেলে তাদের বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক বিভাগ অথবা পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আয়ুর্বেদিক ঔষধ মানসিক বিকাশগ্রস্তদের রোগ নিরাময়ে যতটুকু উপকারী সেরূপ অন্যান্য ঔষধ দ্বারা তা সম্ভব নয় বলে তার দাবি।

 

এছাড়া বিভিন্ন মানসিক ক্লিনিকে রোগীকে রেখে হাজার হাজার টাকা অপচয় করার বিপক্ষে তিনি। সরকার যদি ঔষধ প্রস্তুত করার জন্য একটি আধুনিক মেশিন এবং একটি এম্বুলেন্স দিয়ে তাদের সহায়তা করেন, তবে এ প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে পরিচিতি লাভ করবে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন। আর্থিক সমস্যা সমাধানে দেশের কোন দাতা সংস্থা যদি এগিয়ে আসে, তবে তাদের অগ্রযাত্রায় কোন বাধা থাকবে না। বর্তমান সংকট কাটিয়ে একদিন এ প্রতিষ্ঠানটির সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে  তিনি ও স্থানীয়দের বিশ্বাস।

লেখক : নিজস্ব সংবাদদাতা, চন্দনাইশ।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট