চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সংস্কৃতি চর্চায় পিছিয়ে নেই পটিয়া

নিজস্ব সংবাদদাতা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:৫৬ অপরাহ্ণ

পটিয়ায় মঞ্চ নাটকের সূচনা হয় পটিয়া ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। সুস্থ বিনোদন ও সমাজ কল্যাণের লক্ষ্যে তৎকালীন সার্কেল অফিসার এস.জি. গোমেজ এবং অন্যান্য উদ্যোক্তারা ১৯৪৪ সালে পটিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে এ ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন এর নাম ছিল ‘বরদা মেমোরিয়াল হল’। কবে এ নাম পরিবর্তিত হয়ে পটিয়া ক্লাব হয়েছে তা ঠিক জানা যায়নি। তবে এ ক্লাব প্রতিষ্ঠার আগে পটিয়া অঞ্চলে একেবারে মঞ্চ নাটক হয়নি তা নয়।

 

রাহাত আলী স্কুলের ছাত্র এবং শিক্ষকদের যৌথ উদ্যোগে ১৯৩৭ সালে স্কুল মিলনায়তনে প্রথম মঞ্চস্থ হয় ‘সিরাজের স্বপ্ন’, ১৯৩৮ সালে মঞ্চস্থ হয় ‘মীর কাসেম’ এবং ১৯৩৯ সালে মঞ্চস্থ হয় ‘মেবার পতন’। পর পর মঞ্চস্থ এ ৩টি নাটকেই নাট্য নির্দেশক ছিলেন ভাটিখাইন গ্রামের হরিপদ চক্রবর্তী। পরে তিনি এ বিদ্যাপীঠে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। ছাত্রদের অংশগ্রহণে অভিনীত এ নাটকগুলোতে অভিনয় করেন গোবিন্দারখীলের হিমাংশু ধর, বড়উঠানের ডা. কামাল এ খান, পটিয়ার সামশুল আলমসহ আরো কয়েকজন নাট্যাভিনেতা হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।

 

১৯৮৭ সালে পটিয়ায়া ক্লাব কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকায় অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল আলীম লিখেছেন, নাটক মঞ্চায়নের উপযোগী করে নির্মিত পটিয়া ক্লাব হলে স্থায়ী মঞ্চ সুবিধার কারণে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ক্লাবের নাট্যানুরাগী সদস্যদের মধ্যে নাট্যাভিনয় ও মঞ্চায়নের প্রেরণা জাগে। তার মতে ‘চাঁদ সওদাগর’ পটিয়া ক্লাব নাট্যশিল্পী কর্তৃক মঞ্চস্থ প্রথম নাটক। পরবর্তী এক দশকে মঞ্চস্থ নাটকগুলোর মধ্যে ‘পথের শেষে’, ‘মানুষ’ মঞ্চ সাফল্যের কারণে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। পটিয়ার প্রবীণ সাংবাদিক এসএমএকে জাহাঙ্গীর সম্পাদিত ‘পটিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে পটিয়ার মঞ্চ নাটক নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে।

 

১৯৬০ সালে পটিয়া ক্লাবের নাট্যপ্রেমিক সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘পটিয়া সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী’। এ নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পরবর্তী ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছরে উক্ত ক্লাব মঞ্চ ক্লাব ও গোষ্ঠীভুক্ত সদস্যদের দ্বারা ১৯টি ঐতিহাসিক ও ৪২টি সামাজিকসহ মোট ৬১টি নাটক ১৩২ বার অভিনীত হয়েছে। পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ও সামাজিক অনুদারতার কারণে অভিনেত্রী নির্বাচনের বেলায় তাদেরকে পেশাদার শিল্পীদের উপর নির্ভর করতে হতো।

 

এ সময়ে পরিচালক হিসেবে কুনিয়াৎ ছবুর, গোপাল কৃষ্ণ মহাজন, আবদুচ ছালাম তালুকদার, চৌধুরী মোহাম্মদ হাশেম, আবদুল হক আল্লাই, এম এ হক এবং গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী বেশ খ্যাতি লাভ করেন। অভিনেতাদের মধ্যে ডা. মো. জহুরুল হক, আবদুল মোমেন খাদেমী, নাজিরুল হক, নুরুল ইসলাম, এ কে এম সামশুল আলম, কাজী মনিরুল ইসলাম, মতিউর রহমান ও শফিউদ্দীন নাট্যানুরাগী ও দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

 

আবার এমন ক’জন শিল্পী আছেন, যারা বর্তমানে চলচ্চিত্র, টিভি ও দেশব্যাপী মঞ্চ নাটকে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। যাদের অভিনয়ের প্রাথমিক পর্ব সূচিত হয় পটিয়া ক্লাব রঙ্গমঞ্চ থেকে ১৯৬৮ সালে পটিয়া অফিসার্স ক্লাব আয়োজিত ‘পাকা রাস্তার শিশু শিল্পী হানিফ বর্তমানে বিটিভি’র দর্শকপ্রিয় হানিফ সংকেত। পাকা রাস্তার নৃত্যশিল্পী সেলিনা বর্তমানে চলচ্চিত্র ও মঞ্চ নাটকের আলোচিত চরিত্রাভিনেত্রী। ১৯৭৭ সালে মঞ্চস্থ ‘সিঁদুর নিও না মুছে’ নাটকের চরিত্রাভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের একজন ব্যস্ততম নায়িকা হয়ে উঠেন।

সফল মঞ্চশিল্পী জয়ন্তী দে, শিপ্রা চৌধুরী, মীরা দে ও ছবি সরকারের সাথে এতদঞ্চলের রঙ্গমঞ্চ ও শিল্পীদের অভিনয় সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। রশিদাবাদ গ্রাম নিবাসী আবদুল গফুর হালী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘গুলবাহার’, ‘সতী মায়মুনা’, ‘নীল মণি’, ‘আজব সুন্দরী’, ‘আশেক বন্ধু’ ও ‘কুশিল্যা পাহাড়’ ইত্যাদি নাটক রচনা করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। কেলিশহরের অ্যাডভোকেট দীপক চৌধুরী একজন উল্লেখযোগ্য নাট্য অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক ও নাট্য সংগঠক। তিনি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থিয়েটারের দলপতি ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্পাদক হয়। ‘স্বাধীনতার ময়না তদন্ত’, ‘রাজা এলেন রাজাকার’, ‘আজকের সমাচার’, ‘পরাজয়ের পালা’, ‘বস্তি’, ‘বাঘ সাবধান শিয়াল আসছে’, ‘টোকাই’ ইত্যাদি তার রচিত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম।

 

ভাটিখাইনের মিলন চৌধুরী একজন নামজাদা নাট্যকার, নাট্য সংগঠক ও নাট্য নির্দেশক। তিনি বঙ্গশ্রী শিল্পী সংসদ ও গণায়ন নাট্য স¤প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে তিনি অঙ্গন থিয়েটার ইউনিটের সভাপতি হন। তার রচিত ও নির্দেশিত নাটকের মধ্যে ‘চর্যাপদের হরিণী’, বাংলাদেশের প্রথম পথ নাটক ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’, ‘একজন পিরামিড’, ‘নরক থেকে বলছি’ উল্লেখযোগ্য। বড় উঠানের শিশির দত্ত চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট নাট্য সংগঠক ও নাট্য নির্দেশক। তিনি অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও দলপতি এবং বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি ‘মল্লিকার চোখে জল নাটকটির রচয়িতা।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রফেসর ড. কুন্তল বড়য়া নাট্য নিদের্শক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছেন। গোবিন্দারখীলের অধ্যাপক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী একজন নাট্য সংগঠক, নাট্য নির্দেশক, নাট্য অনুবাদক ও অভিনেতা। তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সম্পাদকমন্ডলীর প্রাক্তন সদস্য ও গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের প্রধান ছিলেন। সুচক্রদণ্ডীর আহমেদ ইকবাল হায়দার একজন নাট্য সংগঠক ও নাট্য নির্দেশক। তিনি তির্যক নাট্য দলের প্রধান ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। ধলঘাটের ভোলা সেন, মুকুট নাইটের দ্বিজেন বড়ুয়া নাট্য অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে, ধলঘাটের রণজিৎ রায় ও গুয়াতলীর সূবর্ণা চক্রবর্তী, সুচক্রদণ্ডীর পরিমল সেন খেলন দক্ষ অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

ডেঙ্গাপাড়ার এস আই মাহবুব নাট্য রচয়িতা, নাট্য পরিচালকও অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়াও করল গ্রামের শৈবাল বড়ুয়া, চরকানাই গ্রামের মাসুদ, নাইখাইনের নাসির উদ্দিন নাসু, দক্ষিণ ভূর্ষির তপন দাশ তপু, মোহাম্মদ ছৈয়দ চেয়ারম্যানসহ আরো অনেক তরুণ নাট্যকর্মী চট্টগ্রামের বিভিন্ন নাট্যসংস্থা ও পটিয়া নাট্যগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত থেকে নাট্যচর্চা করে যাচ্ছেন। বিশ্বের অন্যান্য সভ্য জাতির ন্যায় আধুনিকতার চরম এ উৎকর্ষের যুগে নাটকের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বেড়াজাল ছিঁড়ে মুক্ত সংস্কৃতি চর্চায় পটিয়া আজ পিছিয়ে নেই।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট