চট্টগ্রাম সোমবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩

সর্বশেষ:

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় উৎপাদন বেড়েছে লবণশিল্পে

মিজানুর রহমান

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:১৯ অপরাহ্ণ

পঞ্চাশের দশকে চাঁনখালী খালের তীরে চুন্নু মিয়া যে লবণশিল্পের গোড়াপত্তন করেছিলেন- নানা কারণে তা জৌলুস হারাতে শুরু করে নব্বই দশকের পর। তবে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পটিয়ার ইন্দ্রপুল সংলগ্ন বিসিক শিল্প এলাকার লবণ শিল্পে এখন সুদিন ফিরেছে। সনাতন পদ্ধতির যন্ত্রপাতির পরিবর্তে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করায় এখানকার কারখানাগুলোতে কয়েক বছরের ব্যবধানে লবণ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯০ ভাগ।

 

এতোদিন কাঁচা লবণ ভাঙতে (ক্রাশিং) জাঁতাকল বা চাক্তির চালিত কল ব্যবহার করতেন মিল মালিকরা। পরে লবণ শোধন করে গোলায় রেখে শুকাতেন। কয়েকদিন শুকানোর পর বিক্রির উপযোগী হতো লবণ। তবে এখন ট্যানার মেশিন দিয়ে কাঁচা লবণ ধুয়ে দ্রুত পরিষ্কার করা হচ্ছে। রোলার বা ফ্যান সিস্টেমের ক্রাশার মেশিন দিয়ে লবণ ভাঙা হচ্ছে। সেন্ট্রিফিউজ মেশিন দিয়ে পানি সরিয়ে লবণ দ্রুত শুকানো হচ্ছে। ফলে একই সময়ে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।

 

বিসিকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী- ২০১৮ সালে পটিয়া বিসিকে লবণ উৎপাদন হয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৯২ মেট্রিক টন। ২০১৯ সালে লবণ উৎপাদন হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ১৩৬ মেট্রিক টন। ২০২০ সালে উৎপাদন হয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৫৭ মেট্রিক টন। ২০২১ সালে হয় ২ লাখ ২২ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২২ সালে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৪ মেট্রিক টন লবণ। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে লবণ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ।

 

বিসিকের কর্মকর্তা এবং লবণ মিল মালিকরা জানান- আগে সনাতন পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। এ কারণে লবণ ক্রাশিং ও পরিশোধন কার্যক্রম সময়সাপেক্ষ ছিল। এছাড়া ব্যাংক লোন এবং পুঁজির অভাবে কিছু মিলও বন্ধ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে লবণ উৎপাদন বাড়েনি। তবে গত কয়েক বছরে মিল মালিকরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় লবণ ক্রাশিং ও পরিশোধন কার্যক্রমে গতি এসেছে। এখন ব্যাংক লোনও মিলছে সহজে। ফলে লবণ উৎপাদন বেড়েছে।

 

জানতে চাইলে পটিয়া বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র সানা পূর্বকোণকে জানান, পটিয়ায় এখন প্রায় সব মিল মালিকরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণ ক্রাশিং ও পরিশোধন করছেন। এ কারণে লবণ ক্রাশিং ও পরিশোধন কার্যক্রমে গতি এসেছে। এছাড়া উৎপাদন বাড়াতে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করাসহ বেশি কিছু উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। মিল মালিকরা যেন সহজে ব্যাংক লোন পান সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে লবণ উৎপাদনে।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান- চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফ এলাকায় মাঠে চাষীরা লবণ চাষ করেন। সেখান থেকে কাঁচা লবণ সড়ক ও নৌপথে পটিয়ার ইন্দ্রপুল মোকামে আনা হয়। একটি বড় ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০ মণ, ছোট ট্রলারে ১২ থেকে ২০ মণ, সাম্পান বা বোটে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মণ কাঁচা লবণ থাকে। মোকাম থেকে প্রতি মণ কাঁচা লবণ ৯৮০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় কিনে নেন লবণ মিল মালিকরা।

 

এরপর এসব লবণ বস্তায় ভরে ইন্দ্রপুল সংলগ্ন বিসিক শিল্প এলাকার লবণ ক্রাশিং কারখানাগুলোতে নেওয়া হয়। সেখানে ক্রাশিং মেশিনে লবণ ভাঙার পর পরিশোধন করা হয়। এরপর আয়োডিনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে সারাদেশে বাজারজাত করা হয়। পরিশোধনের পর প্রতি মণ লবণ বিক্রি করা হয় ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। সারাবছরই লবণ উৎপাদন এবং পরিশোধন হয়। তবে মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এবং বৈশাখ মাসে লবণ উৎপাদনের ধুম থাকে।

 

ভালো লবণ উৎপাদন হলেও পরিবহন খরচ বাড়ায় কাক্সিক্ষত লাভের মুখ দেখছেন না পটিয়ার মিল মালিকরা। নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ কম হলেও চাঁনখালী খাল ভরাট হয়ে হওয়ায় এখন এ পথে পণ্য আসছে কম। ভরা মৌসুমে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন ইন্দ্রপুল সংলগ্ন বিসিক শিল্প এলাকার ৪০টি লবণ কারখানায়। তবে নিয়মিত কাজ করেন ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ শ্রমিক। কাজ করে একজন শ্রমিক দিনে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করেন। এরমধ্যে আছেন নারী শ্রমিকও।

 

পটিয়া লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক পূর্বকোণকে বলেন, ‘চাঁনখালী খালকে ঘিরে পটিয়ায় লবণ শিল্পের উৎপত্তি হলেও সেই খাল এখন ভরাট হয়ে গেছে। সড়কপথে লবণ পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। ফলে কাক্সিক্ষত লাভের দেখা মিলছে না।’

 

তিনি বলেন, ‘কিছু অসাধু লবণে আয়োডিন দেন না। সোডিয়াম ক্লোরাইডের বদলে ক্ষতিকর সালফেট দেন। এসব লবণ দেখতে সুন্দর হলেও শরীরের ক্ষতি করে। এটি বন্ধ করা গেলে পটিয়ার লবণ শিল্প আরও সম্প্রসারিত হবে।’

 

লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট