চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সম্ভাবনা আটকে আছে একটি সেতুতে

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৭:১৯ অপরাহ্ণ

লুসাই পাহাড় থেকে সাগরে মিলবার আগে কর্ণফুলী মায়ের মমতায় বুকে জড়িয়ে রেখেছে বোয়ালখালীকে। পূর্বাঞ্চলীয় বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলের ফোঁকর গলে কর্ণফুলী ও বোয়ালখালী খাল আগলে রেখেছে এই জনপদকে। ঐতিহাসিকতা, প্রাসঙ্গিকতা ও অপরিহার্যতা থাকা সত্ত্বেও শহরতলী উপজেলা হিসেবে এগোয়নি গণমানুষের সমান্তরালে।

 

উন্নয়ন আর বোয়ালখালীর মাঝখানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কর্ণফুলী। এলাকাবাসীর ধারণা, কর্ণফুলী নদীর ওপর একটি প্রশস্ত সেতু হলেই উন্নয়নের গাড়ি ঢুকে পড়বে বোয়ালখালীতে। কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট রেল সেতুর পাশে আরেকটি সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের।

 

গণমানুষের প্রাণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর হযরত শাহ আমানত সেতুর (তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কর্ণফুলীতে আরেকটি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত সেতু নির্মাণের স্বপ্নপূরণ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কালুরঘাটে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল। জীবনের জন্য পদত্যাগ করে পাড়ি দেন পরপারে। ২০২০ সালে উপ-নির্বাচনে প্রয়াত সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদও একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এক বছরের মধ্যে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ কাজ দৃশ্যমান হবে।’

 

কিন্তু নতুন সেতু দেখে যেতে পারেননি দুই বর্ষীয়ান সংসদ সদস্য। এলাকাবাসীর ধারণা, কালুরঘাটে একটি সেতুর জন্য আটকে রয়েছে এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা।

 

পর্যটনের সম্ভাবনা: বোয়ালখালীর মানচিত্র তিন দিকে কর্ণফুলীর বেষ্টন। আরেক দিকে পাহাড়ি অঞ্চল। কিংবদন্তি রয়েছে, এই পাহাড়ি অঞ্চলে এক সময় সাধকপুরুষ ও ঋষি-মুনিরা ধ্যান করতেন। যার নিদর্শন কড়লডেঙ্গা মেধস মুনি আশ্রম ও হযরত বু-আলী কলন্দর শাহর আস্তানা শরিফ। দুই ধর্মের তীর্থপীঠ ছাড়াও পাহাড় অদূরে বৈদ্যপাড়ায় রয়েছে বুদ্ধগয়া থেকে আনা গৌতমবুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বোধিদ্রুম বৃক্ষের মূলশাখা। ১৮৭৯ সালে শ্রীমৎ রাধাচরণ মহাস্থবির বুদ্ধগয়া থেকে এনে বৈদ্যপাড়া সর্বজনীন বিহারে রোপণ করেছিলেন। তিন ধর্মের এসব তীর্থস্থানকে ঘিরে আন্তর্জাতিকমানের তীর্থপীঠ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল। পাহাড়, নদী ও ছড়ার অপূর্ব সম্মিলনে ধর্মীয় তীর্থস্থানকে ঘিরে হাতছানি দিচ্ছে পর্যটনের। এমপি বাদলের মৃত্যুর পর সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে।

 

অর্থনীতিতে পাহাড়ি কৃষিপণ্য: পর্যটনশিল্প নয়, পাহাড়ে ফলদ-বনজ ও কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে পাহাড়ি কৃষির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত লেবু, মাল্টা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। দেশের অর্থনীতি বড় অবদান রাখছে। কিন্তু অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও হিমাগারের অভাবে পাহাড়ি কৃষিজ ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক।

 

ওয়াসার ভাণ্ডালজুড়ি প্রকল্প: জ্যৈষ্ঠপুরা পাহাড়ের ঘা ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াসার পানি শোধনাগার প্রকল্প। কর্ণফুলী নদী থেকে প্রতিদিন নয় হাজার কোটি লিটার পানি যাবে দক্ষিণের বিভিন্ন উপজেলায়, বাড়িঘর-শিল্প কারখানায়। এর পাশ দিয়ে পাহাড়ের বুক বেয়ে বয়ে গেছে বোয়ালখালী-রাঙ্গুনীয়া সড়ক। প্রতিদিন ভ্রমণপ্রিয় অগুনতি লোক ছুটে আসেন জ্যৈষ্ঠপুরা পাহাড়ে। হাতছানি দিচ্ছে পর্যটনের অমিয় সম্ভাবনা।

 

বিপ্লবীদের সূতিকাগার: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে বোয়ালখালীর ভূমিকা ছিল সমুজ্জ্বল। নেতাজী সুভাষ বসুর শিক্ষা ও দীক্ষাগুরু বেনী মাধব দাসের জন্ম এই উপজেলায়। ব্রিটিশ আন্দোলনের পুরোধা কল্পনা দত্তসহ অনেক বীরের জন্মভূমি। বলা চলে বিপ্লবীদের সূতিকাগার বোয়ালখালী। ‘৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে উপজেলা সদর, সদরের রইস্যারমার ঘাট, কালুরঘাট সেতু, শাকপুরা, মধ্যম কধুরখীলসহ বধ্যভূমি এখনো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। ১৯৭১-এর ভয়াল ও বিভীষিকাময় দিনের স্মারক জ্যৈষ্ঠপুরা সেন বাড়ি ছিল মুক্তিকামী বীর সৈনিকদের আশ্রয়স্থল। সরকারিভাবে কোনো স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করা হয়নি বধ্যভূমিগুলোতে।

 

ভঙ্গুর-অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা: বোয়ালখালীর যোগাযোগব্যবস্থা এখনো সেকেলের। গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাট অনুন্নত-ভঙ্গুর। প্রধান সড়কটি (হাওলা ডিসি সড়ক) চার লেনের দাবি দীর্ঘদিনের। বছর দুয়েক আগে সংস্কার ও কিছুটা প্রশস্ত করা হয়েছে। বিআরটিসিটির হাতেগোনা কয়েকটি বাস ছাড়া গণপরিবহন বলতে শুধু টুকটুকি টেম্পো আর ট্যাক্সিই একমাত্র ভরসা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষকে পরিবহন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় গুনে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

 

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে কালুরঘাট সেতু থেকে খরণদ্বীপ পর্যন্ত বেড়িবাঁধ কাম সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল। পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলেও একই ধরনের প্রকল্প পরিকল্পনা আঁতুরঘরেই মৃত্যু ঘটে। অনুন্নত সড়ক ব্যবস্থার কারণে এখনো পিছিয়ে রয়েছে কর্ণফুলী ও বোয়ালখালী খাল-তীরবর্তী অঞ্চল পশ্চিম গোমদণ্ডী এবং শাকপুরা ইউনিয়ন। ওই অঞ্চলের ননাইয়ারমার ঘাট যেন এক প্রাগৈতিহাসিক জনপদ। খালের ভাঙন, অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবাসহ নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে অনাদর-অবহেলায় পড়ে রয়েছে।

 

রায়খালীতে তত্তার পুল: বোয়ালখালী পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড ও শাকপুরা ইউনিয়নে ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাথে সংযুক্ত রায়খালী খালের ওপর নির্মিত রায়খালী সেতু যেন ধ্রুপদি সিনেমার দৃশ্যপটকে হারা মানাবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও লোহার খুঁটি ও তক্তার জোড়াতালি দেওয়া সেতু দিয়ে পারাপার হতে হয় দুই ইউনিয়নের হাজারো বাসিন্দাদের।

 

নদী-খালের ভাঙন : কর্ণফুলী নদী, বোয়ালখালী ও ছন্দরিয়া খালের ভাঙন দীর্ঘদিনের। নদী ভাঙনরোধের আশ্বাস শোনে আসছে আড়াই দশক ধরে। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে বোয়ালখালী ও রাউজান অংশের নদী-খালের ভাঙনরোধে ৭২ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। এরপর ভাঙনরোধে আর কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী ও খালের ভাঙনরোধে ১৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

 

আবাদি জমিতে শিল্প-কারখানা: শহরতলী এই উপজেলা হওয়া সত্ত্বেও পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি। আরাকান সড়ক ও কর্ণফুলী নদী ঘিরে গড়ে ওঠে ছোট-বড় অন্তত ৩০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে আবাদি জমি ভরাট করেই। শিল্প-কারখানার আগ্রাসনে দিন দিন কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। এছাড়াও প্রধান প্রধান খাল ও নদী দখল-দূষণে চাষাবাদ হুমকিতে পড়ছে।

 

প্রাগৈতিহাসিক জনপদ: বোয়ালখালীর প্রাচীনত্ব অনুধাবন করা যায় বৌদ্ধ কিংবদন্তিতে। গৌতমবুদ্ধ ঋদ্ধিশক্তিবলে সমগ্র জাম্বুদ্বীপ (উপমহাদেশ) পরিভ্রমণকালে কাঁইচা নদী (কর্ণফুলীর প্রাচীন নাম) অবগাহন করেছিলেন। কূলে ওঠে যেখানে প্রথম চরণ রেখেছিলেন তার নাম হয় চরণদ্বীপ। তারপর আকাশমার্গে চক্রশালা অভিমুখে যাওয়ার পথে যেখানে তাঁর পাদুকা বা খড়ম পড়ে যায় তার নাম হয় খড়মদ্বীপ বা খরণদ্বীপ। এই কিংবদন্তি যাই হোক, গৌতমবুদ্ধ ধ্যানলদ্ধ অতিমানবিক শক্তিবলে (ঋদ্ধি) এই ভূণ্ডের পটিয়ার চক্রশালায় অবস্থান করেছিলেন তার বিবরণ তিব্বতীয় গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব বুড্ডিজম’ ও প্রাচীন কাশ্মীরী ‘অবদান কল্পলতা’ গ্রন্থেও বর্ণনা রয়েছে।

 

বৌদ্ধ কিংবদন্তি মতে বোয়ালখালীর ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের লাগোয়া প্রাচীন এই জনপদ পিছিয়ে রয়েছে যুগ যুগ ধরে। কর্ণফুলীর এপারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শহরের উন্নয়ন ও চাকচিক্যে ভরা। ওপারে অনুন্নত ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, পুল-সাঁকো দিয়ে চলাচল করা পশ্চাৎপদ এক জনপদ। যেন চেরাগ বাতির নিচে অন্ধকার।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট