চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পাহাড় ঘিরে অর্থনীতিতে অমিত সম্ভাবনা

পূজন সেন

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৬:৫৪ অপরাহ্ণ

বোয়ালখালীর পাহাড়ে অবিরাম ছুটে চলা জলাধারার নাম ‘ভাণ্ডালজুড়ি’। শীতে শীর্ণকায় পাহাড়ি এই জলস্রোতে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গমে সারা বছর আপন মনে বয়ে চলে। তবে বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের জলে মাতাল হয়ে ওঠে এ জলধারা। এ জলধারা বা খালের দুইপাশে বিস্তীর্ণ পাহাড় এখন দেশের অর্থনীতির জন্য হয়ে ওঠেছে এক অমিত সম্ভাবনা। ১৩১ দশমিক ৭৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বোয়ালখালী উপজেলার ৩৬ দশমিক ৭৮ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। বাগান সৃজন, পশু পালন, মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ।

 

বোয়ালখালীর পাহাড়ি অঞ্চল রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, পাবর্ত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও ভারতের মিজোরাম পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশাল এই পাহাড়ি অঞ্চল ঘিরে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা।

 

পাহাড়ি অঞ্চল জ্যৈষ্ঠপুরা, আমুচিয়া ও কড়লডেঙ্গা চট্টগ্রাম নগরের অতি কাছেই। নদী পার হলেই সদর থেকে মাত্র ৫-৬ কিলোমিটারের দূরত্ব। এ অঞ্চলে উৎপাদিত ফসল সরবরাহ হয় দেশীয় বাজারে। দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সমৃদ্ধ করছে দেশের অর্থনীতিকে। বনজ, ফলদ গাছের পাশাপাশি এ অঞ্চলে মাছ চাষ ও গরু-মহিষ ছাগল পালন করেন প্রান্তিক কৃষকরা। গড়ে উঠছে আধুনিক পদ্ধতির নতুন নতুন খামার। পাহাড়ের ছোট-বড় প্রায় ২২টি জলাশয়ে হয় মাছ চাষ। ৩ শতাধিক প্রান্তিক কৃষকের রয়েছে গবাদিপশুর খামার। নির্দিষ্ট সীমানা নেই এসব পশুর। মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় দল বেঁধে। গোধূলি বেলায় যে যার স্থানে ফিরে আসে গরু-মহিষের পাল। খুব একটা যত্ন-আত্তির প্রয়োজন পড়ে না বলে জানিয়েছেন কৃষক লিটন বড়ুয়া।

 

দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে নদী তীর ঘেঁষে জ্যৈষ্ঠপুরায় ভাণ্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার নির্মাণ করছে ওয়াসা। এতে আরো দ্রুত বদলে যাচ্ছে জ্যৈষ্ঠপুরা পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড়ি অঞ্চলের জীবনমানেও এসেছে পরিবর্তন।

 

উপজেলার কৃষি অফিসের পরিসংখ্যানে জানা যায়, উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় ২২০ হেক্টর জায়গাজুড়ে রয়েছে লেবু বাগান। এ অঞ্চলে লিচু বাগান রয়েছে ৫০ হেক্টর, আম বাগান ২০ হেক্টর ও মাল্টা বাগান ১০ হেক্টর। এছাড়া কুল, কমলা, ড্রাগন, পেঁপে, পেয়ারা, কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফলের চাষে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠছে। এছাড়াও শাক-সবজি, আদা, হলুদের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে।

 

পাহাড়ে উৎপাদিত লেবু প্রতিদিনই পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান বোয়ালখালী থেকে। বছরে ২০-২২ কোটি টাকার লেনদেন হয় লেবুর বাজারে। এখানকার উৎপাদিত লেবু চট্টগ্রামের সিংহভাগ চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ করা হয় ঢাকার কারওয়ানবাজার, শ্যামবাজার, কুমিল্লার লাকসাম বাজার ও নোয়াখালী বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মাল্টার বাজারও ভালো বলে জানিয়েছেন চাষিরা। প্রতি কেজি মাল্টা পাইকারিতে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। বাগান থেকে কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন প্রজাতির লেবুর ভিড়ে কাঁটালেবুর কথা না বললেই নয়। স্থানীয়রা কাঁটালেবুকে বলেন ‘কাঁটাজামির’। ওষুধি গুণে ভরপুর এ লেবুর চাহিদা রয়েছে প্রতিটি ঘরে।

 

বোয়ালখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ বলেন, উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল ঘিরে রয়েছে কৃষির অপার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই এখন সচ্ছল। আমরা সহযোগিতা করে যাচ্ছি আগ্রহী কৃষকদের। আমরা চেষ্টা করছি চাষিদের আরো বেশি আগ্রহী করে তুলতে। তিনি বলেন, ফলের উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় থেকে বাজারে ফল আনার জন্য যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানো, সংরক্ষণ বা মজুতের যথাযথ সুবিধা গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

 

কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চাষি জ্যৈষ্ঠপুরার মোজাম্মেল হক বকুল বলেন, ‘সঠিক সময়ে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে না পারায় বাগানের লেবু বাগানেই পচে যায়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে প্রান্তিক চাষিরা ন্যায্যমূল্য পেতেন। তাই এ অঞ্চলে হিমাগারের দরকার। এছাড়া মৌসুমের ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ও হিমাগার নির্মাণ করা গেলে কৃষকরা আরো উপকৃত হতেন।’

 

শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম জানান, পাহাড়ি অঞ্চলকে ঘিরে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বোয়ালখালী উপজেলার বিশাল একটি অংশ পাহাড়ি অঞ্চল। কৃষি, পর্যটন ও কুটির শিল্পকে সম্প্রসারিত করা গেলে দেশীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।

 

তিনি বলেন, এ অঞ্চলের সম্ভাবনাকে যুগপৎ করে তোলার লক্ষ্যে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চৌধুরী এমপি জ্যৈষ্ঠপুরা অংশে ব্যাপক উন্নয়ন করে চলেছেন। ভাণ্ডালজুড়ি থেকে রাঙ্গুনিয়া সরফভাটা পর্যন্ত পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

 

চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল পাহাড়কে ঘিরে দেখেছিলেন অন্যরকম এক স্বপ্ন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ এমপিও পাহাড়ি অঞ্চলে অর্থনৈতিক জোন গড়ার প্রস্তাবনা দিয়েছেন।

 

বু-আলী কালন্দর শাহ (রহ.) মাজার গেট হতে উদরবন্যা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হলে সহজতর যোগাযোগের আওতায় আসবে উত্তর-দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি অঞ্চল। জোট সরকারের আমলে বান্দরবান ও চট্টগ্রামের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীসময়ে প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। যোগাযোগের দুর্গমব্যবস্থার কারণে অনাবাদি পড়ে রয়েছে ২৬ হাজার একর পাহাড়ি জমি। এতে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলার সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন ও কৃষি ইকোনোমিক জোন।

 

লেখক : নিজস্ব সংবাদাদাতা, বোয়ালখালী

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট