চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চাষের জমি এখন বিরানভূমি

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৬:৪২ অপরাহ্ণ

বোয়ালখালী খাল। বোয়াল জাতীয় মাছের প্রাচুর্য ছিল বলে খালটির নাম বোয়ালখালী হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পটিয়ার সোনাইছড়ি ও নলুয়ার ছড়া এবং বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা পাহাড়ি ছড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে সাপের লেজের মতো এঁকেবেঁকে ৪০-৪৫ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলীতে মিশেছে। পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে সোনাইছড়ি, আকবর আলী, হারগেজি, বৈদ্যানি খাল হয়ে কড়লডেঙ্গা মঞ্জুর হাটখোলায় এসে বোয়ালখালী খালে যুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ খালটি বয়ে যাওয়ার পথে উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছে তার জলধারা। এসব খালের পানিতে দুই উপজেলার হাজার হাজার একর জমিতে বিভিন্ন মৌসুমে ধান ও সবজি-শস্য আবাদ করা হতো। তা যেন কল্পনাতীত। স্রোতস্বিনী এ খালটি এখন দখল-ভরাট ও দূষণে হারাতে বসেছে সেই সোনালী ঐতিহ্য।

 

স্বাধীনতার আগ থেকেই বংশ পরম্পরায় চাষাবাদে যুক্ত রয়েছেন কড়লডেঙ্গার সাবেক ইউপি মেম্বার কুমকুম দাশ। পাহাড়-নদী ও খালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর জীবন-জীবিকা, নানা স্মৃতি। তিনি বললেন, কড়লডেঙ্গা এলাকায় তিনটি সেচপাম্পের মাধ্যমে ৭-৮ শ কানি জমির চাষাবাদ হতো। এখন চাষ হয় বড়জোড় ২-৩ শ কানিতে। কর্ণফুলী নদী ভরাট, পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, খাল ও শাখা খাল দখল-ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহে বাধা এবং পাহাড়ি ঢলে জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও ঋতুভিত্তিক ফসল ও শস্য চাষাবাদের মৌসুম ও সময় বদলে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে চাষাবাদে।

 

বোয়ালখালী খালের মঞ্জুর হাটখোলা থেকে আকবর আলী খান ও সোনাইছড়ি খাল নামে দুটি খাল আবার বোয়ালখালী-পটিয়ায় বয়ে গেছে। সোনাইছড়ি পাহাড়ি ছড়ার সঙ্গে মিলে চাষে বড় অবদান রাখছে। এসব খালগুলোও এখন মৃতপ্রায়।

 

সারোয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেন বলেন, ‘বোয়ালখালী ও শাখা খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার এখন শত শত কানি জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে।’

 

বোয়ালখালী খাল আবার জন্ম দিয়ে দিয়েছে গরু লুটার খাল, দুমুখো খাল, পাঁচরিয়া খাল এবং একাধিক শাখা-প্রশাখা। এপার-ওপারে দুই উপজেলার বিস্তৃর্ণ এলাকার চাষের একমাত্র মাধ্যম ছিল খালটি। শান্ত- স্রোতস্বিনী খালটি এখন ভরাট ও দখলে অশান্ত হয়ে ফুঁসে ওঠেছে। কেড়ে নিচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি ও জমা-জমি। একই সঙ্গে জোয়ারের পানিতে প্রবাহ বাধা পেয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ।

 

বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদণ্ডীর ননাইয়ারমার ঘাট এলাকার মো. বাবুল বলেন, চাষাবাদ ও যোগাযোগব্যবস্থার প্রধান ভরসা ছিল খালটি। এখন শিল্পকারখানার বড় বড় ট্রলার চলাচলের কারণে খালে তীব্র ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। কেড়ে নিচ্ছে ঘরবাড়ি, জমা-জমি। এছাড়াও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে থাকে ফসলি জমি।

 

বোয়ালখালী খাল ছাড়াও চাষাবাদ ও নৌ-বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যমে রায়খালী খাল, ছনদারিয়া খালের অবস্থাও তথৈবচ। প্রধান খাল ছাড়াও অর্ধশতাধিক ছোট-শাখা খালের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে।

 

স্থানীয়রা জানান, প্রায় দুই দশক থেকে গ্রামাঞ্চলে শিল্প-কারখানার দ্রুত প্রসার ঘটেছে। বোয়ালখালী উপজেলায় কর্ণফুলী নদী ও সংযুক্ত খালের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠেছে ছোট-বড় অন্তত ২০টি শিল্পকারখানা। নতুন করে গড়ে উঠছে আরও ১০টি কারখানা। নদী-খাল ও বড় সড়কের আশপাশের আবাদি জমির ওপর গড়ে ওঠেছে এসব কারখানা। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় নদী ও খালে। ছড়িয়ে পড়ছে ধানী জমি ও আশপাশের এলাকায়। মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে কৃষি জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে বাড়ি-ঘর। শিল্পায়ন ও বাড়িঘর নির্মাণে খাল-বিল হারিয়ে যাচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। মজা জমিতে পতিত হয়ে চাষের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।

 

কৃষি বিভাগের হিসাব বলছে, প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। ইটভাটা, কলকারখানা, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ স্থাপন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।

 

পশ্চিম গোমদণ্ডী ইউনিয়নে বড় অংশজুড়ে চাষ হতো রায়খালী খালের পানি প্রবাহে। গোমদণ্ডী ফুলতলী এলাকার ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বাচা বলেন, আরাকান সড়কে দুইপাশে দুটি খাল প্রবাহিত ছিল। দুই পাশে এখন গড়ে ওঠেছে ছোট-বড় শিল্পকারখানা। খাল দখল-ভরাট করে গড়ে উঠছে এসব কারখানা।

 

এতে চাষের জমি হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও খাল ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ বাধা পেয়ে চাষের জমি ও এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতে চাষাবাদ কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরাকান সড়ক দুপাশে ১০-১৫ বছর আগেও জমিগুলো ধান ও নানা ধরনের শস্য আবাদ হতো। আর খালে মিলতো প্রচুর মাছ। একটি খাল বেদখল হতে হতে এখন শিল্প-কারখানার পেটে ঢুকে গেছে। পানি প্রবাহ না থাকায় বিস্তৃর্ণ এলাকায় কচুরিপানা ও ঘাসে ভরে গেছে। চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

 

বোয়ালখালী কৃষি বিভাগের তথ্য, উপজেলার আবাদি জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৩২৫ হেক্টর। পতিত বা অনাবাদি জমির পরিমাণ ৩২৫ হেক্টর।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ বলেন, বোয়ালখালীতে খাল দখল বা ভরাটের তথ্য জানা নেই। তবে উপজেলার কয়েকটি বিলে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ধরনের অভিযোগ বা তথ্য পেলে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

 

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেচের সংকট, সেচ-চাষাবাদের খরচ বেড়ে যাওয়া, বর্ষায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, কৃষিজীবী মানুষ জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হয়ে পড়া, কৃষিকাজে নতুন প্রজন্মদের অনাগ্রহ ও একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ায় চাষাবাদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে শিল্পায়নে ছোঁয়ার বড় প্রভাব পড়েছে কৃষিজমিতে।

 

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, বোয়ালখালী

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট