চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩

সর্বশেষ:

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১:০২ অপরাহ্ণ

ইফতেখারুল ইসলাম

অধরাই থাকলো কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন

কিছু এলাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) নিয়ন্ত্রণ করে আর কিছু অংশ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। এর উপর রয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তাই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি চতুর্মুখী শাসনের চাপায় পিষ্ট হাটহাজারী উপজেলার। অথচ শহর সংলগ্ন এ উপজেলাকে পরিকল্পিতভাবে উপশহর হিসেবে গড়ে তুলে শহরের উপর মানুষের চাপ কমানো যেত। শহরে চাকুরি-ব্যবসা কিংবা লেখাপড়া করে হাটহাজারীতে বাসা নিয়ে বসবাস করতে পারতো। প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় এখন হাটহাজারীর মানুষদেরও বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে।

 

হাটহাজারীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দার সাথে আলাপ হয় পূর্বকোণ প্রতিবেদকের। তারা জানান, দক্ষিণ হাটহাজারীর বিশাল একটি অংশ ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অধিভুক্ত হয়ে গেছে। চসিক ১ নম্বর ওয়ার্ড পুরোটাই হাটাহাজারী উপজেলার। নগরায়ণের ফলে এ উপজেলায় প্রতিবছর অন্তত ৪ শতাংশ হারে কৃষি জমি কমছে। তবে বন্দরনগরীর সাথে লাগোয়া এ উপজেলাকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার সুযোগ থাকলেও তার কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ ব্রিটিশরা হাটহাজারীর কদর বুঝেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাটহাজারীতে একটি বিমানবন্দর নির্মিত হয়েছিল। তাতেই হাটহাজারীর গুরুত্ব বুঝা যায়। কিন্তু হাটহাজারীকে একটি পরিকল্পিত শহরতলী হিসেকে গড়ে তোলা যায়নি। শহরতলীর বাসিন্দা হয়েও হাটহাজারীর মানুষকে চট্টগ্রাম শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে চাকুরি ও ব্যবসা করতে হয়। হাটহাজারীর অনেক শিক্ষার্থী শহরের স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে বাসা ভাড়া নিয়ে। আবাসন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে শহরের চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ হাটহাজারীতে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে পারতো। সকালে শহরে এসে চাকুরি, ব্যবসাসহ যার যা কাজ তা করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে পারতো। তাতে শহরের উপর চাপ কমে যেত।

 

হাটহাজারী সদর এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, আনোয়ারাকে শহর হিসেবে গড়ে তুলে চট্টগ্রাম শহরের সাথে যুক্ত করতে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। হাটাহাজারীর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে উপশহর হিসেবে গড়ে তুলতে এত টাকার প্রয়োজন হবে না।

 

অক্সিজেন-হাটহাজারী-রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি ব্যস্ততম এ মহাসড়কের হাটহাজারী অংশে কিছুদূর অন্তর বাজার। সড়কের বড় একটি অংশ দখল করে গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব কারণে এই সড়কের নিত্যযাত্রীদের তীব্র যানজটে পড়তে হয়। সড়কের পাশে মালামাল রাখা, ফুটপাত দখল ও যাত্রী ওঠানামা করতে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার কারণে যাত্রীরা অতিষ্ঠ। হাটহাজারীর বাসিন্দাদের পাশাপাশি এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী রাউজান, ফটিকছড়ি ও খাগড়াছড়ির একাধিক যাত্রীর সাথে আলাপকালে তারা জানান, হাটহাজারীর বাজারসমূহ সড়ক থেকে অন্য কোথাও উপযুক্ত জায়গায় সরিয়ে পরিকল্পিতভাবে বাজার নির্মাণ করে দিলে যানবাহন চলাচলে আর বিঘ্ন ঘটতো না। একইভাবে বাজারের ক্রেতারা স্বাচ্ছন্দ্যে কেনা-কাটা করতে পারতো। এতে উভয়পক্ষের লাভ হতো। সড়ককে গাড়ি পার্কিং স্পেস হিসেবে কেউ যাতে ব্যবহার করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও প্রশাসনকে করতে হবে।

 

হাটহাজারীতে লক্ষ্মীচরণ সাহার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি, নন্দী বাড়িসহ বেশকিছু জমিদার বাড়ি রয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এসব বাড়ি সংরক্ষণ করা জরুরি। যদিও ক্রমান্বয়ে এসব ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে। ঐতিহাসিক বাড়িগুলো ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।

 

জানতে চাইলে হাটহাজারীর বাসিন্দা চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ সালাম পূর্বকোণকে বলেন, হাটহাজারীতে অনেক কিছু করা প্রয়োজন। সরকার সারাদেশে মডেল মসজিদ নির্মাণ করছে যা এখানে হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখানে আছে। এখানে আইটি পার্ক হওয়া প্রয়োজন। অক্সিজেন-খাগড়াছড়ি সড়কের অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী পর্যন্ত ডিভাইডার আছে। হাটহাজারী থেকে ফটিকছড়ি পর্যন্ত সড়ক ডিভাইডার দেয়ার মত প্রশস্ত হয়নি। সড়কটি চার লেন করা অতীব জরুরি। উপজেলার ইন্টারনাল সড়কগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। গত ১৪ বছরে এসব সড়কের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ হওয়া উচিত ছিল। হাটহাজারীতে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হওয়ার পেছনে তার অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার থাকাকালে এটি আদায় করেছেন। এর প্রধান কারণ হল এখানে থাকা ডেইরি ফার্ম, কৃষি ফার্মের আরো সুফলের সুযোগ সৃষ্টি করা। তিনি জানান, দেশের প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি ইনস্টিটিউট আছে। সরকার প্রবাসীদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদেশ পাঠাতে চায়। এ ধরনের ইনস্টিটিউট হাটহাজারীতে নেই। হালদায় যে বেড়িবাঁধ হয়েছে তার অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণ নেই। হাটহাজারীর বিস্তীর্ণ এলাকা পতিত হিসেবে পড়ে আছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে। এসব জমি আবাদী করার ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধির কোন উদ্যোগ নেই। এখানে খেলার মাঠ করার উপযুক্ত জায়গা আছে। কিন্তু মাঠ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেই। একটি কৃষি ইনস্টিটিউট আছে। সেটিকে কলেজে রূপান্তর করার দাবি দীর্ঘ দিনের যাতে এখান থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে ভাল চাকুরি করতে পারে। হাটাহাজারী রেললাইনে ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে লাইন ফটিকছড়ি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। হাটহাজারীতে একটি বড় খেলার মাঠ থাকা খুবই জরুরি। তিনি নিজে সুযোগ পেলে এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন।

 

সামাজিক সংগঠন হাটাহাজারী ফেলোশিপের নির্বাহী সভাপতি ডা. কিউ এম অহিদুল আলম পূর্বকোণকে বলেন, পানিসেচের অভাবে হাটহাজারীর বিস্তীর্ণ জমিতে বোরো আবাদ হয় না। সরকার গভীর নলকূপ স্থাপন করে দিলে কৃষকরা চাষাবাদ করতো। উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মান তলানীতে ঠেকেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউএনও এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে উপজেলার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে কয়েকটি মনিটরিং টিম গঠন করা যায়। যারা পুরো উপজেলাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিয়ে একেকটি টিম একেকটি অংশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনিটর করবেন। হাটহাজারী শহরের সংলগ্ন একটি উপজেলা হয়েও যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত করুণ। ট্রেন সেবা থাকলেও অনিয়মিত চলাচল করে। নাজিরহাট পর্যন্ত প্রতিটি ট্রেন যায় না। সড়ক পথে গণপরিবহন না থাকায় অবৈধ ছোট যানবাহনের দৌরাত্ম্যে নাগরিক দুর্ভোগ চরমে। যুবসমাজ যাতে বিপথে না যায়, সে লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন ও পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। হালদার পাড়ে অনেকগুলো স্পট আছে যেগুলো সাজানো হলে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হবে। এসব উদ্যোগ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তিনি।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট