চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

ফতেয়াবাদবাসীর দুর্দশার দেড় দশক

ইফতেখারুল ইসলাম

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

ফতেয়াবাদের দুই লাখ মানুষের দুর্দশা দীর্ঘ দেড় দশকেও লাঘব হয়নি। হাটহাজারী উপজেলার এই এলাকার প্রায় ৭ হাজার একর ভূমিতে এই দীর্ঘ সময় ধরে বাড়ি-ঘর নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে না সিডিএ। যেহেতু স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন নেই, তাই জমির ক্রেতাও নেই। ক্রেতা এলেও উপযুক্ত দাম দিতে চায় না। এ কারণে আটকে গেছে অনেকের বিদেশ যাত্রা, চিকিৎসা, মেয়ের বিয়ে কিংবা নতুন ব্যবসায় শুরুর কাজ।

 

দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডটি চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থিত। ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাশে আছে পাহাড় এবং পাহাড়ের ঢালে কৃষি জমির পাশাপাশি জনবসতি আছে। এখানে কোনো পরিত্যক্ত জমি নেই।

 

ফতেয়াবাদ এলাকায় ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০০৭ সালে। ৪ হাজার ৭শ’ একর জায়গার ওপর আধুনিক উপশহর গড়ে তোলার প্রাথমিক কিছু কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও শেষতক প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে প্রণীত ড্যাপে ওই প্রকল্পটির এলাকা ২ হাজার ৩শ’ একর বাড়িয়ে ৭ হাজার একরে উন্নীত করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে শুরু করে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। ত্রিমুখী প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে এই এলাকার মানুষ। কিছু অংশ সিডিএ, কিছু ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং কিছু অংশ হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে। এতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে এলাকাবাসী।

 

নকশা অনুমোদন এবং বাড়িঘর উচ্ছেদ না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে ‘বসতভিটা রক্ষা কমিটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রকল্পটি বাতিলের দাবিতে সংগঠনটি ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপিও দিয়েছে সংগঠনটি। তাদের সাফ কথা, বাপ-দাদার বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে দেবেন না তারা। তারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নয়। তারা চান, বাড়িঘর রেখেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করুক সিডিএ।

 

স্থানীয় কাউন্সিলর গাজী শফিউল আজিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দক্ষিণ পাহাড়তলীর প্রায় ৭ হাজার একর জায়গা অধিগ্রহণের নাম দিয়ে ব্যক্তি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে সিডিএ। কেউ জমি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্য যায়, কেউ মেয়ে বিয়ে দেয়, কেউ ব্যবসা শুরু করতে চায়। কিন্তু কিছুই পারছে না। দক্ষিণ পাহাড়তলীতে জন্মগ্রহণ করাটাই যেন এখন পাপে পরিণত হয়েছে। প্রায় দুই লাখ মানুষ অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন থেকে শুরু করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সবার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখ কষ্টের মধ্যে আছে মানুষ। সিডিএ চেয়ারম্যান সাহেব বার বার আশ্বস্ত করেন। কিন্তু কোন সহযোগিতা করেননি।

 

বসতভিটা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক দুর্গাপদ নাথ বলেন, জমি অধিগ্রহণ হবে এই কথা শোনার পর থেকেই এই এলাকায় জমি বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রেতা আসতে চায় না। কারণ নকশার অনুমোদন মিলছে না। পাশের চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে প্রতিগণ্ডা জমি ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ফতেয়াবাদে কয়েক লাখ টাকার বেশি দাম ক্রেতারা দিতে চায় না।

 

প্রকল্প পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বার বার বলেন, পরে আসেন। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করার পর সিডিএ একটি বিবৃতি দিয়ে বলে, যেসব বাড়ি আছে তা বাদ দিয়েই আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হবে। এমনকি সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম চৌধুরী হাটের পোস্ট অফিসের সামনে সভা করে ঘোষণা দিয়েছিলেন বাড়ি, মসজিদ, কবরস্থান, মন্দির ইত্যাদি বাদ দিয়ে আবাসন করা হবে। বাড়ি নির্মাণের অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু কোনো আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি।

 

এলাকার বাসিন্দা গাজী আক্কাস পূর্বকোণকে বলেন, সিডিএ পত্রিকায় ২৯ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বলেছে। এখানে বর্তমানে প্রতিগণ্ডা জমির মৌজামূল্য ৭ লাখ টাকার উপরে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে যে টাকা চাওয়া হয়েছে তাতে গণ্ডা প্রতি দুই লাখ টাকার বেশি হবে না। তাই এটি একটি কাল্পনিক প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে প্রতিগণ্ডায় প্রায় ২২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তার সাথে উন্নয়ন চার্জ যোগ করলে প্রতি গণ্ডায় খরচ পড়বে ৩০ লাখ টাকার উপরে। সিডিএ এখানে প্লট বিক্রি করবে কত টাকায়?

 

নগর পরিকল্পনায় জড়িত বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন সূত্র জানায়, ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে চিটাগাং ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সিডিএ)। তখন এর স্ট্রাকচার প্ল্যান এরিয়া ধরা হয় ১১৫২ স্কয়ার কিলোমিটার। এরপর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ১২টি আবাসিক এলাকার গোড়াপত্তন ঘটে। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তুলতে পারলে সিডিএ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতো। তাতে ব্যর্থ হওয়ায় শহরের প্রসার ঘটছে অপরিকল্পিতভাবে।

 

সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস দাবি করেন বেশ ক’টি স্থানে হাউজিং প্লট সৃষ্টির সিদ্ধান্ত রয়েছে সিডিএ’র। যার মধ্যে রয়েছে ফতেয়াবাদ টাউনশিপ প্রকল্প, বায়েজিদ হাউজিং, উর্মিলা, নীলিমা ইত্যাদি। কিন্তু গত এক যুগ সময় ধরে নতুন আবাসন এলাকা সৃষ্টি হয়নি কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভূমির ক্ষতিপূরণ মৌজা মূল্যের তিনগুণ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে সিডিএ থেমে নেই। ফতেয়াবাদ টাউনশিপ প্রকল্পটি সংশোধন করা হচ্ছে। সার্ভে করে প্রায় ৬ হাজার একর ভূমি প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে। প্রায় এক হাজার একর ভূমিতে আবাসিক প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। সেখানে প্রতি কাঠা ভূমির প্রস্তাবিত মূল্য রাখা হয়েছে ১২ লাখ টাকা। প্রস্তাবটি এখন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের অপেক্ষায় আছে।

 

তিনি জানান, ৬ হাজার একর ভূমি প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হলেও সেখানে পরিকল্পিত নগরায়ণ হবে। পরিকল্পিতভাবে সড়ক বড় করা হবে। সিডিএ’র অনুমতি নিয়েই যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট