চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সীতাকুণ্ড বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও দূষণে বিপর্যস্ত জনপদ

মোস্তফা ইউসুফ

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১:২৩ অপরাহ্ণ

একপাশে সমুদ্র ও অন্যপাশে অরণ্যঘেরা সারিবদ্ধ পাহাড়, বুক চিড়ে চলে যাওয়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক, কাছেই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এসব মিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল সীতাকুণ্ড দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ। উৎপাদিত পণ্য সহজেই বন্দরে পৌঁছে দেয়া বা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সুবিধা সীতাকুণ্ডকে বণিকদের কাছে শীর্ষ গন্তব্য স্থানে পরিণত করেছে। যার ফলশ্রুতিতে সীতাকুণ্ডজুড়ে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে সীতাকুণ্ড বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক জাহাজভাঙা শিল্পের কারণে।

 

সীতাকুণ্ডে একে একে গড়ে ওঠেছে ভারী শিল্প, জাহাজভাঙা শিল্প, রি-রোলিং মিলসহ অসংখ্য শিল্প-কারখানা। এ অঞ্চলের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক সুবিধার সুবিধাভোগী হয়েছেন ও হচ্ছেন অসংখ্য শিল্পকারখানার মালিক। বিনিময়ে সীতাকুণ্ড জনপদকে দিতে হচ্ছে অপূরণীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশগত মূল্য। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি ছড়া, খাল, পাহাড় গিলে খাচ্ছে বড় বড় সব কনগ্লোমারেট প্রতিষ্ঠান।

 

অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে পানির স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে। আড়াই হাজার ফুট গভীরে গিয়েও মিলছে না পানি। এভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া মানে যে কোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পে ভূমিধস হওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেয়। এ রকম যদি কিছু হয় সীতাকুণ্ডের একটা বিশাল জায়গা ভূগর্ভে মিশে যাবে। ইস্পাত তৈরির কারখানায় পানির চাহিদা ব্যাপক। দেশের ইস্পাতের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ হয় সীতাকুণ্ড থেকে। সমস্যা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি, খাল-বিল, পাহাড় এসবের উপকারিতা ভোগ করত সাধারণ মানুষ। পরিবেশের ক্ষতি করে এসব শিল্প উৎপাদনে কারখানার মালিকরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও, দূষণের দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকেই।

 

সীতাকুণ্ডের সার্বিক পরিবেশের দূষণ নিয়ে তেমন কোন সরকারি জরিপ বা গবেষণা হয়নি। যদি হত তাহলে নিঃসন্দেহে উঠে আসত এ অঞ্চলের পানি, বায়ু ও মাটির বিপর্যস্ত অবস্থা। আরেক ভয়াবহ বিপদ কনটেইনার ডিপো নিয়ে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যেন-তেনভাবে গড়ে ওঠা এসব ডিপো ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে সীতাকুণ্ডে জনজীবনকে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে সীতাকুণ্ডবাসীর এ ভয় আরও বদ্ধমূল হয়েছে।

 

জাহাজভাঙা শিল্পের ক্ষতিকর প্রভাবে ৪০ কিলোমিটার উপকূলজুড়ে সামুদ্রিক মাছ হারিয়ে গেছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এরকম হাজার হাজার জেলে পেশা পরির্তন করে দৈনিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজাভাঙা শিল্পে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের করা এক গবেষণায় সীতাকুণ্ডের মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রমাণ করে- কীভাবে জাহাজভাঙার দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। যার কারণে কৃষির উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।

 

জাহাজভাঙা থেকে নির্গত হয় প্রায় এক ডজনের বেশি বিষাক্ত পদার্থ যার মধ্যে এসবেস্টস খুবই ভয়াবহ। মূলত জাহাজের ইঞ্জিনরুমে থাকা এসব এসবেস্টস শ্রমিকের ফুসফুসে জমা হয়ে তাদের মৃত্যুকে তরান্বিত করছে। এছাড়াও জাহাজের কেবিন রুমে কাঠ দিয়ে তৈরি দেয়ালের পরতে পরতে জমা থাকে এসব বিষ। মূলত অগ্নিদুর্ঘটনার সময় যাতে আগুন ছড়িয়ে না পড়তে পারে, সে জন্য এসব এসবেস্টস রাখা হয়। কিন্তু জাহাজভাঙার পর সে এসবেস্টসযুক্ত কাঠকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে ফার্নিচারেরর দোকান। এসব দোকানেই সস্তা দরে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বিষযুক্ত এসব ফার্নিচার। আবার দামে কম হওয়ায় ফার্নিচারগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে চলে যায় সারাদেশে। আর এভাবেই জাহাজভাঙার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে সর্বত্রে।

 

পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্লিপ্ততা ও রাজনৈতিক চাপ : সামগ্রিক এসব দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ করার কথা থাকলেও প্রভাবশালীদের চাপে আইন প্রয়োগ অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়েও রোষানলে পড়তে হয় পরিবেশের কর্মকর্তাদের। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের কক্ষে আড্ডা দেয়ার সময় এমনও দেখেছি মন্ত্রী, এমপিদের ফোনে বাধ্য হয়ে জরিমানা মওকুফ করতে হচ্ছে।

 

সমস্যার অন্যদিক হল পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা ও জনবল না বাড়ানো। মেয়াদ উত্তীর্ণ জাহাজের ভেতরে কী কী বিষাক্ত পদার্থ আছে সেটা নিরুপণ করার মত কারিগরি সক্ষমতা পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই। অন্যদিকে, যেভাবে কারখানার সংখ্যা বেড়েছে, পরিবেশগত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে সে তুলনায় তাদের জনবল বাড়ানো হয়নি। জনবলের অভাবে কারখানাগুলোতে এফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (বর্জ্য শোধন ব্যবস্থা) চালু থাকে কিনা, সেটা নিশ্চিত করতে পারেন না তাঁরা। অন্যদিকে, উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এসব প্ল্যান্ট চালাতে অনাগ্রহী থাকেন শিল্পমালিকরা। এখানে সরকার একটা প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে। যেসব কারখানা পরিবেশ আইন সম্মতভাবে উৎপাদন করে তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দিলে কারখানা মালিকরা উৎসাহিত হবেন। শুধু আইন প্রয়োগে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা যাবে না সেটা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট হয়েছে।

 

মানুষের ইতিহাসে শিল্পবিপ্লব জগত বদলে দেয়ার মত ঘটনা। শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনকে আরামদায়ক করেছে, পণ্যের যোগানকে সহজ করে নাগরিক জীবনকে উপভোগ্য করেছে। এরই হাত ধরে বহুজাতিক পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর দূরতম গ্রামে। এবং তার এ অভিগমনের অনিবার্য সঙ্গী হয়েছে দূষণ। ঊনিশ শতকের যে শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, বিংশশতকে এসে সেটাই মানুষের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। শিল্প উৎপাদনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বেড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে ব-দ্বীপের মত অঞ্চলগুলোর সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।

 

এ প্রভাব থেকে মুক্ত নয় উপকূলীয় উপজেলা সীতাকুণ্ড। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার যে বেষ্টনী উপকূলের ম্যানগ্রোভ বন সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা ও ভাঙনের কারণে সীতাকুণ্ডজুড়ে শত শত একর ম্যানগ্রোভ বন হারিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সীতাকুণ্ড এলাকায় আট হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে ইকোনমিক জোন করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বনবিভাগের কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। এভাবে একদিকে শিল্প কারখানার ধকল, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সীতাকুণ্ড অঞ্চল ধুঁকছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ পরিকল্পিত শিলাঞ্চল গড়ে তোলা, পরিবেশ আইন কার্যকর করা, দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করা।

 

শিল্পায়নজনিত সমস্যার এটি বৈশ্বিক দিক। জাতীয়ভাবে আমরা শিল্পবর্জ্য শোধন ও পরিবেশ রক্ষায় একাধিক আইন প্রণয়ন করলেও বাস্তবে চলছি উল্টো পথে। শুধুমাত্র উন্নয়ন কেন্দ্রিক চিন্তার ফলাফল হচ্ছে অসংখ্য নদীর দূষণে মৃত্যু, অসংখ্য বনের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, সমুদ্রে প্লাস্টিকের স্তূপ জমে বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটা দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি করা। দিনশেষে উন্নয়ন ভরকেন্দ্রে থাকে মানুষ। মানুষের টিকে থাকার মত পরিবেশ ধ্বংস করলে, শুধু উন্নয়ন থাকবে, উন্নয়নের সুফল ভোগ করার মত কোন মানুষ থাকবে না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট