চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রোহিঙ্গা আতঙ্কে সন্দ্বীপবাসী

সন্দ্বীপ সংবাদদাতা

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:২৬ অপরাহ্ণ

সন্দ্বীপ থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কেন্দ্র ভাসানচর। বর্তমান সারিকাইত ইউনিয়নের পশ্চিমে সাবেক ন্যায়মস্তিসহ উত্তরের মাইটভাঙ্গা, আজিমপুর ও রহমতপুর ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া ভূমিতে নতুন করে চর উঠাতে আনন্দের সীমা ছিল না প্রতিনিয়ত নদী ভাঙনের শিকার দ্বীপবাসীদের। ভালোবেসে নতুন চরের নাম দিয়েছিল ঠেংগার চর। কিন্তু যখনই সরকার থেকে ঘোষণা আসে এই চরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র করা হবে, তখন থেকে মন ভেঙে যায় চার লাখ সন্দ্বীপবাসীর।

 

একদিকে নিজেদের জমি নোয়াখালীর নামে চলে যাওয়া, অন্যদিকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের আশ্রয়ের কারণে আতঙ্কিত সন্দ্বীপের সাধারণ মানুষ। ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচর রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু হয়। এরপর থেকে ভাসানচর থেকে সন্দ্বীপ রুট হয়ে রোহিঙ্গারা পালাতে শুরু করে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা সন্দ্বীপ হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পালিয়ে গেলেও কেউ কেউ থেকে যাচ্ছেন সন্দ্বীপে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে অবনতি ঘটছে সন্দ্বীপের সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। স্থানীয়দের সহায়তায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন রোহিঙ্গারা।

 

বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ৩০ মে ৪ শিশু, ৮ নারী ও ২ পুরুষসহ ১৪ জন, ৫ জুলাই ৭ জন, ১৮ জুলাই ৯ জন, ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল ৩ জন, ১ সেপ্টেম্বর ৪ জন এবং ৪ সেপ্টেম্বর ৪ জনসহ বিভিন্ন সময় প্রায় ১৫০ জন রোহিঙ্গা নাগরিক ও একজন দালাল সন্দ্বীপের স্থানীয় জনতার হাতে আটক হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩১ জন রোহিঙ্গা আটক হয় মুছাপুর ইউনিয়নে। রোহিঙ্গারা সন্দ্বীপের সারিকাইত, মাইটভাঙ্গা, মুছাপুর, রহমতপুর, গাছুয়া, আজিমপুর, মগধরা ও উড়িরচর ইউনিয়নে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েছে।

 

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কিছু অংশ ধরা পড়লেও অনেক রোহিঙ্গা এখনো সন্দ্বীপ পালিয়ে থাকার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ২০২১ সালের ২০ আগস্ট সন্দ্বীপের গাছুয়া ইউনিয়নে আটক হওয়া রোহিঙ্গা আল আমিন (২০) স্থানীয় জনগণের কাছে স্বীকার করেন, তিনি এবং তার সঙ্গে আরও একজন চার মাস যাবত সন্দ্বীপে বসবাস করছেন। সন্দ্বীপের হাসান নামের এক যুবক তাঁদের কাজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে আসে। তাদের দিয়ে ইয়াবা, গাঁজা এবং অস্ত্র ব্যবসা করানো হচ্ছে। তবে আল আমিন আটক হলেও তার সঙ্গীর এখনো কোন খোঁজ নেই।

 

মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান বলেন, সন্দ্বীপে যেভাবে অবাধে রোহিঙ্গা আসা শুরু হয়েছে তা বন্ধ না হলে সন্দ্বীপের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। তারা অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে।

 

ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে স্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করছেন। ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে মারজিয়া আক্তার (১৯) নামে এক রোহিঙ্গা তরুণী আটক হয়। মারজিয়া আক্তার পাসপোর্ট করতে গেলে তার কথাবার্তা সন্দেহ হলে পাসপোর্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তারা তাকে আটক করেন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ বলেন, ‘চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাউরিয়া এলাকার বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন এক তরুণী। আবেদনের সাথে তিনি জন্মসনদ, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র দেন। একইভাবে ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস থেকে রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ আরমানকে আটক করা হয়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে তার আঙুলের ছাপ যাচাই করে দেখেন ওই ব্যক্তি ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট আরমান (১৯), বাবার নাম সৈয়দ আলম উল্লেখ করে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধন করেন। কিন্তু পাসপোর্টের আবেদনে উল্লেখ করে, তার বাবার নাম ফয়সাল আমীন ও মায়ের নাম মারজান। বয়স ১৯ বছর। স্থায়ী ঠিকানা সন্দ্বীপ উপজেলার হরিশপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এছাড়া আরমান ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অবৈধভাবে করা জন্ম নিবন্ধন সনদ ও সন্দ্বীপের ঠিকানায় করা তার মায়ের এনআইডির অনুলিপিও জমা দিয়েছিল।

 

স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন সময় আটক রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোহিঙ্গারা নোয়াখালী ও সন্দ্বীপের স্থানীয় দালাল ও জেলেদের সহায়তায় মাছ ধরা নৌকায় ভাসানচর থেকে সন্দ্বীপ চলে আসেন।

 

২০২১ সালের ৩০ মে সন্দ্বীপের মুছাপুর ইউনিয়নে আটক হওয়া ১৪ রোহিঙ্গার একজন মিনহা ইমতিয়াজ (২৫) বলেন, আমরা ৩০-৪০ জন ভাসানচর থেকে নোয়াখালীতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা করে দালালকে দিয়েছিলাম। আমাদের পরিবারের সদস্যরা কুতুপালং ক্যাম্প থেকে বিকাশে দালালদের কাছে টাকা পাঠিয়েছিল। বোটওয়ালা নোয়াখালীতে নামানোর কথা বলে আমাদের সন্দ্বীপ নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।

 

২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল আটক ৩ রোহিঙ্গার একজন আবদুল হোসেন (২৭) বলেন, আমরা তিনজন ২১ হাজার টাকার চুক্তিতে ভাসানচর ৭৮ নম্বর ক্লাস্টারের কামাল দালালের মাধ্যমে কক্সবাজার যাওয়ার চুক্তি করি। রাত ১১টায় কামাল দালাল আমাদের একটি নৌকায় করে সন্দ্বীপ পাঠায়। পরে সন্দ্বীপ থেকে কক্সবাজার পাঠানোর কথা ছিল। অবৈধভাবে নদী পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক সময় ঘটে দুর্ঘটনা।

 

২০২১ সালের ১৪ আগস্ট গভীর রাতে ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় নৌ দুর্ঘটনার শিকার হন ২১ শিশুসহ ৪১ জন রোহিঙ্গা। প্রাণ হারান ১১ শিশুসহ ১৫ জন। গত ২৭ ডিসেম্বর নদী পাড়ি দিতে গিয়ে ওসমান গণি নামের এক বাঙালি নাগরিক মারা যায়। ওইদিন সকালে পুলিশ সারিকাইত ইউনিয়নের কালির চর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। ওসমান গণি দেড় বছর আগে এক রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করে ভাসানচর বসবাস শুরু করে।

 

ভাসানচর থেকে সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার। ভাসানচরের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সন্দ্বীপ উপকূলে কোন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় সহজেই রোহিঙ্গারা নদী পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপ চলে আসতে পারছেন।

 

সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের জেলেরা বলেন, ভাসানচরের কাছাকাছি গেলে রোহিঙ্গাদের মাছ ধরতে দেখা যায়। তারা কূলের কাছে ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরেন। অনেক রোহিঙ্গা এখন সন্দ্বীপ ও ভাসানচরের চরের খসকি ও চরঘেরা জালের শ্রমিকের কাজ করেন।

 

সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নদীপথে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর দায়িত্ব নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডের। স্থলভাগে রোহিঙ্গা ধরা পড়লে কোস্টগার্ডের মাধ্যমে আমরা তাদের ভাসানচর পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। রোহিঙ্গারা যাতে সন্দ্বীপে কোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা সর্বদা সতর্ক আছি।’

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট