চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফটিকছড়ি উপজেলা : প্রয়োজন পরিকল্পিত উন্নয়ন

ইফতেখারুল ইসলাম 

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের বৃহৎ উপজেলা ফটিকছড়ির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে বেশকিছু এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন খাতে পিছিয়ে পড়া এই জনপদের মানুষের এগিয়ে চলার পথে বাধাও আছে অনেক। উন্নয়ন বঞ্চনার ফলস্বরূপ উত্তরের মানুষ এখন ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ নামে আলাদা একটি উপজেলা গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন। ফটিকছড়ির বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনসমূহ দীর্ঘদিন ধরে একে জেলা ঘোষণার দাবিও জানিয়ে আসছেন। ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে কথা হয় পূর্বকোণ প্রতিবেদকের। তারা নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন। হালদা নদীর উপর নাইছ্যের ঘাট এবং সিদ্ধাশ্রম এই দুই স্থানের যেকোনো একটি ঘাটে ব্রিজ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। সুয়াবিলের মানুষকে ফটিকছড়ি আসতে হয় হাটহাজারী-নাজিরহাট ঘুরে। অপরদিকে, রাউজান-ফটিকছড়ির সীমান্ত এলাকা সর্তা খালের রাউজান অংশে বেশকিছু ব্রিজ হয়েছে। ফটিকছড়ি অংশে একটিও হয়নি। নারায়ণহাট বাজার সংলগ্ন কাঠের ব্রিজটি নির্মাণেও উদ্যোগ নেই। কৃষির জন্য পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা নেই। হালদা এবং বিভিন্ন শাখা খালের পানি ব্যবহারের উদ্যোগ নেই। যা নিশ্চিত করা গেলে ফসল উৎপাদন বেড়ে যেত। ফটিকছড়ির যে উন্নয়ন হচ্ছে তা অপরিকল্পিত হওয়ার কারণে পরিপূর্ণ সুফল মিলছে না।
সড়ক যোগাযোগ : রামগড় স্থলবন্দরকে কেন্দ্র করে একটি অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বদলে যাচ্ছে ফটিকছড়ির ওই অংশের প্রধান সড়ক-মহাসড়কের দৃশ্যপট। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে শতাধিক ব্রিজ-কালভার্ট। অপরদিকে উপজেলার প্রায় ২ হাজার কি.মি গ্রামীণ জনপদের এখনো অনুন্নত ১৪৭৫ কি. মি। সবচেয়ে পিছিয়ে বাগানবাজার, দাঁতমারা, নারায়নহাট, ভূজপুর, সুন্দরপুর ও খিরাম ইউনিয়ন। ফটিকছড়ি সদরস্থ ফটিকছড়ি পৌরসভা এবং নাজিরহাট পৌরসভা থাকলেও এই দুই পৌরসভার সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। উত্তরের মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে ‘ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলা’ নামে নতুন একটি উপজেলা গড়ার কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত উত্তরের মানুষ : নাজিরহাটের ৫০ শয্যার উপজেলা হাসপাতাল থেকে মূলত সেবা পান নাজিরহাট এবং আশপাশের হাটহাজারীর মানুষ। ফটিকছড়ি উপজেলা সদর বিবিরহাটে ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হলেও সেখানে জনবল নেই। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দূরত্বের কারণে উত্তর ফটিকছড়ির মানুষ এই দুই হাসপাতাল থেকে সেবা নিতে পারেন না।
পড়ে আছে বিপুল পতিত জমি : উপজেলায় পতিত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ১০৪ হেক্টর। চাষাবাদের আওতায় আনা হলে এসব পতিত জমিতে শাক-সবজি, সরিষা, চিনা বাদাম, সয়াবিন, ভুট্টা, মুগডাল, সূর্যমুখী, ডাল জাতীয় পণ্য ও মিষ্টি আলুর চাষাবাদ করা যাবে।
ইটভাটা-ফটিকছড়িবাসীর জন্য বিষফোঁড়া : ফটিকছড়িতে ফনিক্স নামে পরিবেশবান্ধব একটি মাত্র ইটভাটা আছে। বাকিগুলো প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। উজাড় করছে জমির উর্বর টপ সয়েল। পাইন্দং হতে ভূজপুর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে। দক্ষিণ ফটিকছড়ির ধর্মপুর, খিরাম ও বক্তপুর এলাকায়ও ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। উজাড় হচ্ছে বন। এ নিয়ে বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও এর কোনো প্রতিবাদ করছেন না।
অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ : গহিরা-হেঁয়াকো সড়কের জাহানপুর কলেজ, কোর্টের পাড় বৌদ্ধবিহারসহ বিভিন্ন অংশে যেসব ব্রিজ কালভার্ট রয়েছে তার বেশিরভাগের মুখেই পাকা দালান কিংবা অন্যকোন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু এই সড়ক নয়, বিভিন্ন সড়কের ব্রিজ-কালভার্টের মুখে ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কারণে একসময় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এছাড়া প্রবাসীরা ফসলি জমি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ করছেন। যা এক সময় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বন্যা : ফটিকছড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতিবছর বন্যাকবলিত হয়। সমিতির হাট, জাফতনগর, বক্তপুরের একাংশ, সুয়াবিল, পাইন্দং, ভুজপুর, দাঁতমারাসহ বিভিন্ন এলাকার ফসল বর্ষাকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাগানবাজারে ভারত থেকে পাহাড়ি ঢল নামে। বিশেষ করে উত্তর ফটিকছড়ির রাস্তা-ঘাট বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যায়। ক্ষতি হয় কৃষকের ফসলের।
মাদক ব্যবসা : স্থানীয়রা জানিয়েছেন দাঁতমারা মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট। রামগড় সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল আসে। এদিক থেকে ইয়াবা যায়। ফটিকছড়ি সদরও ইয়াবার বড় হাট বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ফটিকছড়ি ক্লাব লি. এর সভাপতি নাসির উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, বৃহত্তর ফটিকছড়িতে একটি সরকারি মহিলা কলেজ নেই। ফটিকছড়ি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারি করে সেখানে কলেজ অনুমোদন হওয়া দরকার। সুযোগের অভাবে এখন অনেক মেয়ে এসএসসি পাসের পর উচ্চ শিক্ষা নিতে পারছে না। প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া দরকার। দূর-দূরান্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অবকাঠামো ও শিক্ষক সংকট রয়েছে।
তিনি বলেন, ফটিকছড়িকে তিনটি উপজেলা করে প্রশাসনিক অবকাঠামো বিকেন্দ্রীকরণ হলে উন্নয়ন দ্রুত হবে। প্রধান সড়কের উপর বাজার যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সড়ক থেকে বাজার সরানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। ফটিকছড়ি সদরের ২০ শয্যা হাসপাতালটিতে জনবল নিয়োগ দিয়ে সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্তদের যথাযথ মনিটর করে সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে ফটিকছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, বিশাল উপজেলায় যতটুকু উন্নয়ন দরকার ছিল তা করা সম্ভব হয়নি। ৭১ সালে পাক হানাদাররা ফটিকছড়ির অনেক গ্রাম জ¦ালিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার সারাদেশের ন্যায় ফটিকছড়িতেও পুনর্বাসনের কাজ করেছিল। কিন্তু ৭৫ পরবর্তী ঝংকার সিনেমা ছাড়া ফটিকছড়ির দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি। ওই সিনেমা হলের কারণে সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে।
তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর গহিরা-হেঁয়াকো সড়ক করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুটি পৌরসভা হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। সব রাজনৈতিক নেতা এগিয়ে এলে অনেক উন্নয়ন হতো। রামগড় সীমান্তে স্থল বন্দর চালুর ফলে ফটিকছড়িবাসীর ব্যবসার সুযোগ হবে। সেই লক্ষ্যে ফটিকছড়িতে সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। নাজিরহাট রেললাইন রামগড় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। ১৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে হালদা, ধুরুং এবং লেলাং খাল বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।
নতুন সড়কের স্বপ্ন : এ টি এম পেয়ারুল জানান, লেলাং ইউনিয়ন হতে গোপালঘাটা আদর্শ বাজার, বাবা ভাণ্ডারী খামার, গামরিতলা কামালের দোকান, দলিল মুন্সির ঘাট, হলদিয়া, রক্তছড়ি, বর্মাছড়ি হয়ে কাউখালী পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের চেষ্টা চলছে। ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই সড়কে দুটি বড় ব্রিজ হবে। পূর্ব ফটিকছড়ির বিশাল অংশ এবং রাউজানের বড় একটি অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে ওই এলাকার পরিবর্তন ঘটবে। বিশ^ ব্যাংকের সাথে কথা চলছে।
তিনি বলেন, কাক্সিক্ষত উন্নয়ন না হওয়ার কারণ হল নেতৃত্বের অভাব। যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা কখনো ফটিকছড়ি নিয়ে ভাবেননি। ফটিকছড়ির রেমিটেন্স যোদ্ধারা বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত রেখেছেন। এই বিপুল পরিমাণ অলস টাকা ব্যবহারের জন্য তাদেরকে উদ্যোক্তা বানানো গেলে বিশাল পরিবর্তন আসবে। ফটিকছড়িতে এখন সন্ত্রাস নেই। যে কারণে বিনিয়োগের পরিবেশ এবং অব্যবহৃত জায়গা আছে। স্থল বন্দরের জন্য টার্মিনাল ডিপো করার প্রচুর জায়গা আছে।
এ টি এম পেয়ারুল জানান, সমস্ত স্কুল- মাদ্রাসা পাকা হয়েছে। কিন্তু লেখাপড়ায় মনোযোগ কম। ক্যাডার সার্ভিসে যাচ্ছে খুবই কম। সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মনোযোগ কম। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক রয়েছে। কেজি স্কুলে না দিয়ে সেখানে দিতে পারেন। মাদ্রাসা ছাত্ররা মাস্টার্সের সমমান সনদ পাচ্ছেন। তারাও ক্যাডার সার্ভিসে আসতে পারেন। সুন্দর ফটিকছড়িকে আরো সুন্দর করা যায় সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট