চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রত্যাশিত শান্তি এখনো ফিরেনি পাহাড়ে

সাখাওয়াৎ হোসেন রুবেল, রাঙামাটি

২ ডিসেম্বর, ২০২২ | ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে পাহাড়ে বিদ্যুতায়ন হয়েছে, রাস্তাঘাট বেড়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এ অঞ্চলের বনায়ন, পর্যটন, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন বাড়েনি। পাহাড়ে ভূমির ব্যবহার, বিশেষায়িত জুমচাষ, কৃষি, কাপ্তাই হ্রদের সাথে সম্পৃক্ত মানুষের জীবন জীবিকার তেমন উন্নয়ন হয়নি। রাঙামাটির একজন সমাজকর্মি তনয় দেওয়ানের এমনই বক্তব্য।

 

অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজির কথা বাদ দিলে চুক্তির হাত ধরে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য অঞ্চলে নেয়া হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ। বিশেষ করে শিক্ষা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবেও সমৃদ্ধি এসেছে পাহাড়ের মানুষের।

 

কিন্তু চুক্তির ‘পূর্ণ বাস্তবায়ন’ না হওয়ায় ক্ষোভ আর হতাশা বাড়ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষের। আশা-নিরাশার এই দোলাচলেই পার্বত্য চট্টগ্রাাম চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে ২ ডিসেম্বর। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(জেএসএস)’র মধ্যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

 

দীর্ঘ প্রায় দুইযুগ ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘স্থায়ী শান্তি’ ফিরিয়ে আনাই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ‘শান্তিচুক্তি’ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিতি পাওয়া এই চুক্তির দুই যুগেও শান্তি ফিরেনি পার্বত্য অঞ্চলে। তবে পাহাড়ি-বাঙালি জাতিগত সংঘাত কমেছে। বেড়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত। শান্তির পরিবর্তে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিতে এখন অস্থির পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ী পল্লীগুলো।

 

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে নানা টানাপোড়েন চলে আসছে গত দুই যুগ ধরে। বেড়েছে অবিশ্বাস আর দুরত্বও। বাস্তবায়ন নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী দুটি পক্ষেরই রয়েছে ভিন্ন মত। পাহাড়ের এ পরিস্থিতির জন্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াকে ‘কারণ’ বলে দাবি করছেন চুক্তি সম্পাদনকারী দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন ‘জনসংহতি সমিতি’। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তুলেছে সংগঠনটি। চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা অবৈধ অস্ত্র আর চাঁদাবাজি, বলছেন রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার।

 

তবে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত ও ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জনসংহতি সমিতি বলছে, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ ভাবে অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।

 

জনসংহতি সমিতি বিভিন্ন সময় দাবি করে আসছে, মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে এখনো কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে, সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যস্থাপনা, বন এবং প্রত্যাগত জেএসএস সদস্যসহ ‘আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু’ ও ‘প্রত্যাগত উদ্বাস্তু’ পুনর্বাসনে উদ্যোগ নাই।

 

আলোচনায় জেলা পরিষদ ও ভূমি বিরোধ : জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন আর ভূমি বিরোধই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে থেমে আছে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন’ (ল্যান্ড কমিশন) এর কার্যক্রম। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি ও রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘চুক্তিটা অকার্যকর হয়ে রয়েছে। মানুষ হতাশ। চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করতে দ্রুত জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন দরকার। ২৫ বছরেও সরকার আঞ্চলিক পরিষদের রুলস অব বিজনেস করে দেয়নি’ তিনি বলেন।

 

সংঘাত থামছে না : ‘পাহাড়ের মানুষের অধিকার আদায়’ আর চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়নের ‘দৃশ্যমান দাবি’র আড়ালে পাহাড়ে এখন সক্রিয় ৬টি আঞ্চলিক সংগঠন সশস্ত্র তৎপরতার লিপ্ত। সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও প্রসীত খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ ন্যাশনালিস্ট পার্টি এবং সদ্য জন্মানো কুকিচীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আলাদা ‘জোট’ করে সংঘাতে জড়িয়ে আছে। তবে নেতৃত্ব আর মতের বিরুদ্ধতা থাকলেও চার আঞ্চলিক দলই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়।

 

অভিযোগ আছে, নানান উৎস থেকে বছরে প্রায় ৩৭৫ কোটি টাকা চাাঁদাবাজি করে আসছে আঞ্চলিক দলগুলো। এসবের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা আর আধিপত্য বিস্তারে নির্বিচারে একের পর এক খুন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় অস্থির হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পরিস্থিতি। আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে প্রাণহানীর পরিসংখ্যান নাই কারো কাছেই।

 

তবে গণমাধ্যমে আসা তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত গত ৯ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) খুন হয়েছেন চার শতাধিক। অপহরণের শিকার হওয়া ৫৫২ জন। এছাড়া প্রসীতপন্থি ইউপিডিএফ’র ৩৫০ জন, সংস্কারপন্থি জেএসএস (এমএন লারমা) দলের ৮৩ জন খুন হয়েছেন প্রতিপক্ষের হাতে।

 

চুক্তি বাস্তবায়ন কত দূর : পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা চুক্তি বাতিল চাই না; তবে চুক্তিতে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো পরিবর্তন করার জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি। তারপর বাস্তবায়ন চাই। বর্তমানের ধারাগুলো বাস্তবায়িত হলে পাহাড়ে বসবাসকারী ৫৪ শতাংশ বাঙালী ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে’।

 

রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা অত্যন্ত আন্তরিক। কিন্তু অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজি চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা। চুক্তি সম্পাদনকারী দুই পক্ষের মধ্যে আস্থা বিশ্বাসের যে সংকট তৈরি হয়েছে তা নিরসনে সবাইকে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পাহাড়ে সন্ত্রাস, খুন, জখম, অপহরণ ও চাঁদাবাজী অব্যাহত রাখলে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে দীর্ঘদিনের অশান্তি দূর করার জন্য শান্তিচুক্তি হয়েছিল। চুক্তি সম্পাদনকারী উভয়পক্ষ আন্তরিক ভাবে চাইলে চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। এর আগে শান্তিচুক্তি প্রত্যাশিত গতিতে বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ সভাপতি ও রাঙামাটির সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, রক্তপিচ্ছিল সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত পার্বত্য চুক্তি আসলে তেমন আশাপ্রদ কিছু বয়ে আনতে পারেনি। যদিও কয়েকটা বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের আন্তুরিকতার অভাবের কারণে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকার না চাইলে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজি হচ্ছে ঠিক, কিন্তু সমতলেও তো হচ্ছে বলেন তিনি।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট