চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সমিতি আছে, গ্রাহকের কোটি কোটি টাকার হদিস নেই

সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকুণ্ড

১১ নভেম্বর, ২০২২ | ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

রোকসানা আক্তার জন্মগত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গৃহিনী। স্বামী মোশারফ হোসেন গাড়ি চালক। তার সামান্য আয়ে সংসার চলে খুঁড়িয়ে। তাই একটু ভালো থাকতে লাভের আশায় বহুকষ্টে সঞ্চয় করা ৭০ হাজার টাকা তারা জমা রাখেন সীতাকুণ্ড পৌরসদরে অবস্থিত আল-আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতিতে। ৫ বছর পর এই টাকা (হিসাব নং ১০৯১) দ্বিগুণ হওয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এই সমিতি। ফলে লাভ তো দূরের কথা এখন আসল টাকাও পাবেন কিনা সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে তারা ধর্ণা দিচ্ছেন উপজেলা সমবায় অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে। শুধু মোশারফ নয় আল-আমানত সমিতিতে কোটি কোটি টাকা রেখে এখন দিশেহারা হাজার হাজার গ্রাহক।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ড পৌরসদরে প্রায় দুই দশক আগে থেকে সঞ্চয় ও ঋণ প্রদান কার্যক্রম শুরু করে আল-আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতি নামক একটি প্রতিষ্ঠান। মো. মুছা নামক একব্যক্তি সমবায় অফিসের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। এই সমিতিতে টাকা রাখলে ৫ বছর পর তা দ্বিগুণ হারে দেওয়া হতো। ফলে এলাকায় তার গ্রাহক দ্রুত বাড়তে থাকে। বর্তমান সময় পর্যন্ত এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। তবে ৫ বছরের মেয়াদ পূর্তি হওয়ায় প্রথম দিকের অনেক গ্রাহক সমিতি ছেড়ে চলে যায় এবং অনেক গ্রাহক আবারো নতুন করে টাকা সঞ্চয় রাখেন।

 

এভাবে সমিতিতে ধীরে ধীরে হাজার হাজার লেনদেন করতে থাকেনন। ৫০ হাজার, ১ লাখ থেকে ৫-১০ লাখ টাকাও এখানে জমা রাখেন অসংখ্য গ্রাহক। সব মিলিয়ে কোটি কোটি টাকা লেনদেন চলতে থাকে। ঠিক এমনি অবস্থায় ২০১৮ সালে আকস্মিকভাবে স্ট্রোক করে মারা যান সমিতির মূল উদ্যোক্তা ও প্রধান নির্বাহী মো. মুছা। এরপর এটির দায়িত্ব নেন মুছার স্ত্রী রুবিনা ইয়াসমিন। ২০২০ সালে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান রুবিনাও। ফলে এই সমিতির পরিচালনা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। গ্রাহকরা তাদের পাওনা টাকার জন্য ধর্ণা দিতে থাকেন আল-আমানতের বন্ধ থাকা অফিস ও উপজেলা সমবায় অফিসে। কেউ কেউ প্রেসক্লাব, থানাতেও গিয়ে অসহায়ত্বের কথা বলতে থাকেন এবং অভিযোগ করেন।

 

এসব অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সমিতির মালিক মো. মুছা ও তার স্ত্রী রুবিনার দুই পুত্র সন্তান আছে। মোশারফ ও আশরাফ। এরা দুই জনই কলেজ শিক্ষার্থী। মায়ের মৃত্যুর পর গ্রাহকদের চাপে তারা সমিতির দায়িত্ব নিতে চাইলেও এত গ্রাহকের দাবিকৃত পাওনা পরিশোধ করার অবস্থা তাদের নেই।

 

আল-আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতির এক গ্রাহক মুক্তি দে জানান, তার তিন লাখ টাকা জমা আছে এই সমিতিতে। আগেও টাকা রেখেছিলেন এবং লাভও পেয়েছেন। এখন তার এই টাকা আর পাবার কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। অনিশ্চয়তার কথা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংবাদপত্র হকার সাজিব কুমার নাথ ও সুজিত বড়ুয়া। সাজিব বর্তমানে ৫০ হাজার টাকা পাওনা। আগে আরো বেশি পাওনা ছিলেন। মুছার স্ত্রীর কাছ থেকে কিছু টাকা তুলে নেন তিনি। অন্যদিকে সুজিব বড়ুয়ার ২ লাখ টাকার ভাগ্যে কি আছে জানেন না তিনি। এসব গ্রাহকদের সবাই এখন কখনো প্রেসক্লাবে, কখনো সমবায় অফিসে ধর্ণা দিচ্ছেন টাকা ফেরত পেতে।

 

এদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, আল-আমানত সমিতি পরিচালনার জন্য নামসর্বস্ব একটি ৬ জনের পরিচালনা কমিটি গঠন করেছিলেন প্রধান নির্বাহী মো. মুছা। কিন্তু তারা ছিলেন কাগজে কলমেই। কখনো কোন ভূমিকা রাখেননি কিছুতে। ফলে এই সমিতির গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ, ঋণ বিতরণ কিংবা অন্যান্য কাজ সব নিজেই করতেন মুছা এবং তার নিয়োগকৃত কয়েকজন কর্মী। ফলে সমিতির এসব টাকা তিনি কোথায় রেখেছেন তা নিশ্চিত নন কেউ।

 

তবে সমিতির দুটি একাউন্টে মোট ১ কোটি ৩২ লাখ টাকার মতো হদিস পাওয়া গেছে। কিন্তু গ্রাহকের সংখ্যা এবং পাওনা টাকার অংক আরো বেশ কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় এই টাকা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সমবায় অফিসার। অন্যদিকে গ্রাহকদের অভিযোগ তাদের টাকা নিয়ে বেশ কিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তি কিনেছেন আল-আমানত সমিতির প্রধান নির্বাহী মো. মুছা। ফলে ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা নেই।

 

এ বিষয়ে বর্তমানে সমিতিটির দায়িত্ব নেয়া মো. মুছার দুই পুত্র মো. মোশারফ হোসেন ও তার ভাই মো. আশরাফ বলেন, আমাদের ব্যাংক একাউন্টে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা আছে। আমরা সমবায় অফিসকে বলেছি এই টাকা ছাড়াও ১টি জমি ও ৩টি দোকান কেনা আছে। সব দিয়ে গ্রাহকদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে। এছাড়া অন্য সম্পত্তিগুলো তাদের সমিতির নয়, বাবার ব্যক্তিগত নামে। গ্রাহকদের টাকা বুঝিয়ে দিতে বললেও মোট কতজন গ্রাহক আছে এখন তা নিশ্চিত নন তারাও।

 

মোশারফ ও আশরাফ বলেন, ১০২২১ জন সদস্য আছে আমাদের। তবে এর মধ্যে অনেকে চলেও গেছেন। তাই প্রকৃত সংখ্যাটা জানি না। সীতাকুণ্ড উপজেলা সমবায় অফিসার মো. শহীদ উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, হাজার হাজার গ্রাহক ঐ সমিতিতে টাকা পাবে। সে তুলনায় তাদের একাউন্টে যে টাকা আছে তা অনেক কম। এই টাকা দিয়ে সবাইকে দেয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে আমাদের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। বুধবার এই টিম তদন্তও করেছে। তদন্ত টিমের সুপারিশ অনুযায়ী সব গ্রাহককে কিছু কিছু টাকা ফেরত দেবার ব্যবস্থা করব আমরা।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট