চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জলবায়ু পরিবর্তন

সিমেন্ট শিল্পে কার্বন নিঃসরণে বিকল্প উদ্যোগ জরুরি

মো. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী

১৫ জুন, ২০২১ | ৬:২৫ অপরাহ্ণ

কংক্রিটের প্রধান উপাদান সিমেন্ট আমাদের চারপাশের পরিবেশ তৈরিতে রাখছে বড় ভূমিকা। কিন্ত আমরা কতটুকু জানি যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে কার্বন নিঃসরণ হয় তার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সিমেন্ট বা কংক্রিট উৎপাদন প্রক্রিয়া! যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারাবিশ্বে যত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় তার ৮ শতাংশের উৎস এই সিমেন্ট বা কংক্রিট। যদি কংক্রিটকে একটি দেশ ধরা হয় তাহলে সেটি হত বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারি দেশ, যা চীন এবং আমেরিকার পরেই অবস্থান করতো।

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখে কংক্রিটের উপাদান সিমেন্ট। কারণ এটি তৈরি বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেন হচ্ছে দুটি গ্রিন হাউস গ্যাস, যা বৈশ্বিক উষ্ণতার সবচেয়ে বেশি দায়ী হিসেবে বিবেচিত। আবহাওয়ার ধরণ পাল্টাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে এবং গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। অনুন্নত এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাসকারি মানুষজন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়ছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলো সাশ্রয়ী এবং টেকসই সমাধানের পথ খুঁজছে। যদিও অনেকের ধারণা যে, সিমেন্ট হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের একটি নির্মাণসামগ্রী, যা সাম্প্রতিককালে খুব বেশি ব্যবহার হচ্ছে, যদিও গবেষকদের মতে এর ব্যবহার চলে আসছে গত কয়েক হাজার বছর ধরে। সিমেন্ট উৎপাদন করতে গিয়ে কাঁচামাল হিসেবে প্রাথমিক ধাপে ব্যবহার করা হয় চুনাপাথর (লাইমস্টোন) এবং মাটি। এগুলোকে প্রথমে চূর্ণ করা হয়, তারপর ঢুকানো হয় বিশাল আকৃতির সিলিন্ডারের ভিতর। সেখানে ১৪০০-১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়, যাকে বলা হয় ক্যালসিনেশন। এসময় উপাদানগুলো ভেঙ্গে ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়। তখন তৈরি হয় ক্লিঙ্কার নামের নতুন এক উপাদান। পরবর্তীতে ক্লিঙ্কারগুলো ঠান্ডা করে মিশানো হয় জিপসাম ও চুনাপাথর। সাথে আনুপাতিক হারে আরও মিশানো হয় লোহার আকরিক অথবা ছাই, যেগুলো স্ল্যাগ এবং ফ্লাইঅ্যাশ নামে বেশী পরিচিত। এরপর সকল মিশ্রণকে একটি বলমিলের ভিতরে চূর্ণ করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় সিমেন্ট, প্যাকেট অথবা বাল্ক ক্যারিয়ারে সরবরাহ করা হয় নির্মাণ সাইটে।

এখন প্রশ্ন হল, কার্বন নির্গমনের জন্য কিভাবে দায়ী এই সিমেন্ট? বিজ্ঞানীদের মতে, ক্লিংকার তৈরি থেকে শুরু করে সিমেন্ট বা কংক্রিট তৈরি এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। কংক্রিট যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণ করে তার অর্ধেক নিঃসরিত হয় সিমেন্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম কার্বনেটের প্রতিক্রিয়ায় আর বাকি অর্ধেক হয় ফসিল ফুয়েল জ্বালিয়ে ক্লিংকার উৎপাদন এর কারণে। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানি সিলেটের লার্ফাজ সুরমা ছাড়া বাকি সব উৎপাদকই আমদানি করা ক্লিংকারের ওপরই নির্ভরশীল। চাহিদার যোগান দিতে বিপুল পরিমাণ ক্লিংকার উৎপাদনের কার্বন নিঃসরণে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের অনেক সূচকের মধ্যে নির্মাণ বা অবকাঠামো খাত অন্যতম। মাথাপিছু বাৎসরিক সিমেন্ট ব্যবহারে যদিও বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে, তারপরও সামগ্রিক সূচকে বিশ্বে সিমেন্ট ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকেই থাকে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট ব্যবহার হয়, চীনে যা মাথাপিছু ১ হাজার ৮০০ কেজি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে মাথাপিছু ৩২০ কেজি এবং মিয়ানমারে ২৮০ কেজি। সে হিসেবে মাথাপিছু মাত্র ২০০ কেজি সিমেন্টের ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার নিচের দিকে হলেও আয়তনের হিসেবে আমাদের এই ছোট্ট দেশটির বার্ষিক চাহিদা প্রায় তিন কোটি মেট্রিক টন সিমেন্ট। যদিও আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার প্রায় দ্বিগুন। বর্তমানে দেশে সক্রিয় ছোট-বড় ৩৭ সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মোট বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন।

বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদার ২০-২৫ শতাংশ লাগে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে, ১০-১৫ শতাংশ ব্যবহার হয় শিল্প কারখানা তৈরিতে এবং বাকি প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি ঘর নির্মাণে। বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদন করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর বাকি প্রায় ৮০ শতাংশ চাহিদার যোগান দিয়ে থাকে আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো। নির্মাণ বা স্থাপনাশিল্পে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের হার কমিয়ে আনতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং নামি দামি কোম্পানিগুলো বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। কিছু কিছু কোম্পানি ইতিমধ্যেই তাদের কার্বন নির্গমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে এনেছে। ‘নেট-জিরো’ বলতে একটি শব্দ বৈশ্বিক কোম্পানি বা সংস্থাগুলো ব্যবহার করতে শোনা যায়। এর মানে হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে এই মিশনকে সফল করতে। তারা স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে এই লক্ষে। অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের হার কোথায় নামিয়ে আনা হবে আর চূড়ান্তভাবে ২০৫০ সালে এই নিঃসরণের হার কিভাবে শূন্যে নামিয়ে আনবে। উৎপাদন এবং বিক্রয় উভয়ক্ষেত্রে বিপুল হারে প্রবৃদ্ধি হলেও, মানসম্মত ও প্রকৃতিবান্ধব সিমেন্ট বা টেকসই  কংক্রিট উৎপাদনে বাংলাদেশ এগিয়েছে খুব সামান্যই। অন্যতম উৎস হলেও সরকারি বা বেসরকারিভাবে সিমেন্ট শিল্পের কার্বন নির্গমনরোধ বা কমানোর কোনো উল্ল্যেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই। বিশ্বে বিকল্প উপায়ে সিমেন্টের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশীয় উৎপাদকদের তেমন কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে বহুজাতিক কিছু কোম্পানি পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট উৎপাদন সীমিত আকারে শুরু করেছে। অন্যদিকে একেবারে হাতেগোনা দেশীয়  কিছু উৎপাদকও ক্লিংকারের পরিমাণ কমিয়ে স্ল্যাগ বা লাইমস্টোন ব্যবহারের হার বাড়িয়ে নতুন ধরনের সিমেন্ট উৎপাদন শুরু করেছে, যা  অপ্রতুল হলেও প্রশংসার দাবি রাখে।

বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো যে প্রক্রিয়ায় কার্বন নিসরণ কমাচ্ছে তা আমাদের দেশীয় কোম্পানি বা সংস্থাগুলো অনুসরণ করতে পারে। এর মধ্যে ৩ টি উদ্যোগ খুব আলোচিত হচ্ছে। ১) গ্রিন কংক্রিট : বিশ্বে নির্মাণ খাতে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হচ্ছে ‘গ্রিন-কংক্রিট’। এই কংক্রিটের জন্য সিমেন্ট ক্লিঙ্কার কমিয়ে বিকল্প কাঁচামাল যেমন স্ল্যাগ এবং লাইমস্টোন বেশি পরিমাণে দিয়ে উৎপাদন করা হয়। তা ছাড়া গ্রিন কংক্রিটে খুব কম পরিমাণে বিদ্যুত ব্যবহার হয়, ন্যূনতম কার্বন নিঃসরণ হয়। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে বিবেচিত বিকল্প কাঁচামালগুলো বিভিন্ন ভারী শিল্প যেমন স্টিলমিল বা উৎপাদনমুখী অন্যান্য শিল্প যেমন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের বাই-প্রোডাক্ট হতে এই ধরনের কাঁচামাল পাওয়া যায়। কাজেই এইরকম কয়েকটি কাঁচামাল বিবেচনায় নেয়া যায় যেমন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া ফ্লাইঅ্যাশের ব্যবহার বাড়ানো, স্টিল শিল্পের অ-লৌহ উপাদান স্ল্যাগের ব্যবহার বাড়ানো, ফাইবার গ্লাস বা গ্লাসের বর্জ্য, ধান থেকে তৈরি হওয়া ছাই, পোড়া মাটি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ক্লিকার যেহেতু পুরোপুরি  আমদানি নির্ভর কাজেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েরও সুযোগ হবে।

দেশের সাধারণ ব্যবহারকারিরা তাদের ঘরবাড়ি নির্মাণে কম ফ্লাইঅ্যাশ এবং বেশি ক্লিকারের সিমেন্টের প্রতি বেশি আগ্রহী। তাদের অনেকের ধারণা ফ্লাইঅ্যাশ ব্যবহারের সিমেন্টে নির্মাণ শক্তিশালী বা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাদের এই ধারণাও বদলাতে হবে। তাদের জানাতে হবে গ্রিন কংক্রিটের বিল্ডিংয়ের ব্যবহারযোগ্য জায়গা বেশী থাকে, বিল্ডিং শক্তিশালি ও দীর্ঘস্থায়ি হয়, আগুনের বা সূর্যের তাপ শোষণক্ষমতা বেশী থাকে। সর্বোপরি, গ্রিন কংক্রিটের বিল্ডিং লবনসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক দ্রব্য থেকে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দেয়। ২) কংক্রিটের রিসাইক্লিং : আমাদের দেশে এখনো এই ধারণাটি প্রচলিত নয়। উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কংক্রিট রিসাইক্লিং করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এতে ক্লিংকার বা সিমেন্ট উৎপাদন কম হয়। ফলে কার্বন নির্গমনও কমে যায়। ৩) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা বর্জ্য পুনর্ব্যবহার :  বহুজাতিক কিছু কোম্পানি এখন অন্যান্য খাতের বিভিন্ন শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে হাত দিচ্ছে। তারা বিভিন্ন শিল্প যেমন- গার্মেন্টস, খাদ্যপণ্য এবং কৃষিখাতের বিভিন্ন বর্জ্য সংগ্রহ করে এবং যৌথ খরচে প্রক্রিয়াকরণ করে পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা নানান কাজে ব্যবহার করছে এবং সিমেন্ট উৎপাদনেরও এ কাজে লাগাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে আমাদের দেশে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা উচিৎ।

কাজেই সরকারি এবং বেসরকারিভাবে সিমেন্ট ক্লিংকারের পরিমাণ কমিয়ে বিকল্প কাঁচামাল ব্যবহার, গ্রিন কংক্রিট বা গ্রিন বিল্ডিংকে উৎসাহিত করা, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী উৎপাদকদের প্রণোদনা দেওয়া এবং নির্মাণকারীদের পরিবেশের বিষয়ে আরো সচেতন করার মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের উচিৎ এখনই কাজ শুরু করা, যাতে দেশীয় সিমেন্ট উৎপাদন বা কংক্রিট শিল্পে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। অন্যথায় উন্নত দেশগুলো একসময় কার্বন নিঃসরণ তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির দায় আমাদের উপরও চাপিয়ে দিবে এবং জলবায়ু সম্পর্কিত সাহায্য সহযোগিতাও কমে যেতে পারে। আশা করি, সরকার ও উদ্যোক্তারা এ ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ নেবে।

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট