চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

পাহাড়ে ‘অপহরণ’ আতঙ্ক

২৮ মে, ২০২২ | ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

বোয়ালখালী, পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলকে ঘিরে কৃষি অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নানা ধরনের ফলমূল থেকে শুরু করে গাছের বাগান সৃজন করে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন কৃষি উদ্যোক্তা ও বাগান মালিকেরা। নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন কয়েকটি শিল্প গ্রুপও। সম্ভাবনাময়ী কৃষিজ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এসব পাহাড়ে এখন নতুন আপদ দেখা দিয়েছে। গহীন পাহাড়ে আস্তানা গেড়েছেন সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। শ্রমিক ও বাগান মালিকদের জিম্মি করে ‘মুক্তিপণ’ আদায় করে চলেছে। গত দুই মাসে অন্তত দু’শতাধিক শ্রমিক আটকে কয়েক লাখ টাকার মুক্তিপণ আদায় করেছে সন্ত্রাসীরা। জীবনজীবিকার পাহাড় এখন আতঙ্ক ও শঙ্কায় পরিণত হয়েছে। 
দৈনিক পূর্বকোণ কথা বলেছেন একাধিক বাগান মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে। তারা জানালেন, পটিয়া, বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে লেবু, পেয়ারা, মাল্টা, লিচু, আম ছাড়াও নানা ধরনের ফলদ বাগান রয়েছে। রয়েছে সেগুনসহ নানা ধরনের গাছের বাগানও। এখানকার উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা মৌলভিবাজার, পটিয়ার কেলিশহর, রতনপুর, ধলঘাট অংশ এবং রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা এলাকার পাহাড়ি অঞ্চলের দূরত্ব ৬-৮ কিলোমিটার। এরফলে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া ও বোয়ালখালীর বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গহীন পাহাড়ি অঞ্চল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১২ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার ১৪ লেবু বাগান শ্রমিক অপহৃত হন। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান সাত শ্রমিক। ৭০ হাজার টাকার মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে জানান অপহৃতরা। মোবাইল ব্যাংকিং’র মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করা হয়। একই দিনে বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা থেকেও ১০-১৫ জন অপহৃত হয়েছিলেন। অপহৃত শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, গহীন অরণ্যের চাইলত্যাছড়ি ঢালাইর মুখ এলাকা থেকে তাদের অপহরণ করা হয়। অপহৃতদের বাড়ি পটিয়ার কেলিশহর ইউনিয়নের মৌলভিবাজার, মাঝিরপাড়া ও খিল্লাপাড়া গ্রামে।
এ ঘটনার পর ১৮ এপ্রিল পটিয়া অংশে পুলিশ ও র‌্যাব যৌথ অভিযান পরিচালিত হয় পাহাড়ি এলাকায়। কেলিশহর ইউনিয়নের মৌলভিবাজার হয়ে গহীন পাহাড়ে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে পুলিশ-র‌্যাবের এ অভিযান ছিল অনেকটা নিষ্ফল। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে সন্ত্রাসীরা।
পটিয়া থানার ওসি রেজাউল করিম মজুমদার পূর্বকোণকে বলেন, ‘পুলিশি তৎপরতার খবর পেয়ে সন্ত্রাসীরা অপহৃতদের ছেড়ে দেয়। শিগগিরই র‌্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বোয়ালখালী উপজেলার কড়লডেঙ্গা ও পটিয়ার কেলিশহর ইউনিয়নের মৌলভি বাজারের পূর্ব পাহাড়ে অন্তত ২০ শ্রমিককে আটকে মুক্তিপণ আদায় করেছেন সন্ত্রাসীরা।
পূর্বকোণ গতকাল একাধিক বাগান মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাগান মালিক ও কাঠ ব্যবসায়ী জানান, তিন মাস আগে বাগান থেকে গাছ কেটে আনার সময় দুই গাড়ি চালককে আটকে রাখেন সন্ত্রাসীরা। এক লাখ টাকার চাঁদা দাবি করেন তারা। তাদের সঙ্গে রফা-দফা করে এক চালককে দিয়ে ৭০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। পরে মুক্তি পায় দুই চালক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বাগান মালিক বলেন, সন্ত্রাসীরা রাঙ্গুনীয়া উপজেলার সরফভাটা এলাকা। কামাল ও তোফায়েল বাহিনী বলে জানা গেছে। একেকজনের ১০-১৫টি মামলা রয়েছে বলেও ফোনে জানিয়েছেন সন্ত্রাসীরা। এখন পাহাড়ে আস্তানা গড়ে তোলেছেন। বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন তারা।
স্থানীয় ও অপহৃত একাধিক ব্যক্তি বলেন, গত বৃহস্পতিবার কড়লডেঙ্গার শতাধিক লোক বিভিন্ন পাহাড়ে কাজ করতে যান। সমতল ভূমি থেকে ১০-১২ কিলোমিটার গহীনে ওৎপেতে থাকেন সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ি ঢাল ও ছড়া ধরে গহীন পাহাড়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মারধর ও গাছে বেঁধে ফেলা হয়। একে একে ৭০-৮০ জন শ্রমিককে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে স্থানীয় ৮-১০ জনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়েছে। অন্যদের কাছে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়।
এর আগেও কড়লডেঙ্গা ও কেলিশহরের পাহাড়ি এলাকায় অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন ৩২ বাগান মালিক ও শ্রমিক।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবারের অপহরণের বিষয়ে বোয়ালখালী থানা পুলিশকে অবহিত করার পরও কোনো উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। শেষে জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ এ ফোন করার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তাও ছিল গা-ছাড়াভাব।
বোয়ালখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবদুল করিম বলেন, ‘পাহাড়ে বড় অভিযানের প্রস্তুতি চলছে।’
কড়লডেঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হামিদুল হক মন্নান গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘অপহৃত লোকজন ও তাদের স্বজনেরা আজ (গতকাল শুক্রবার) বিষয়টি জানিয়েছেন। অস্ত্রধারী ১০-১৫ জন সন্ত্রাসী ৫০-৬০ জন শ্রমিককে জিম্মি করেছিল। অনেককে মারধর করে টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যরা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।’
শুধু বোয়ালখালী ও পটিয়া অংশে নয়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা এলাকায়ও অপহরণের শিকার হয়েছেন তিন শ্রমিক। গত ১৫ মে সকাল ৮টার দিকে সরফভাটা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের বড়খোলাপাড়া এলাকায় ধান কাটার সময় ৩ শ্রমিক অপহৃত হন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ত্রিপুরা সুন্দরী এলাকার গহীন বন থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। জমির মালিক গণমাধ্যকে জানিয়েছেন, অজ্ঞাত ব্যক্তিরা মোবাইলে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। চাঁদা আদায়ের জন্য ৩ শ্রমিককে অপহরণ করা হয়েছিল।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে অপহরণের ঘটনা ঘটলেও মুক্তিপণ ছাড়া কেউ ফিরে এসেনি। দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই তিন শ্রমিককে উদ্ধার করেছিল। 

পূর্বকোণ/এস 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট