চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

হজের ইতিহাসে মহামারীর দৃষ্টিপাত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

১৩ জুলাই, ২০২১ | ১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ

২০২০ সালে ও ২০২১ সালে করোনা মহামারীর প্রভাবে হজের ইতিহাসে চরম প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছে। ২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশে করোনা মহামারীর উৎপত্তি হলেও ২০২০ সালের মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এতে নিরাপত্তার স্বার্থে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল থেকে বিদেশ থেকে ওমরাহ যাত্রী বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ঐদিন ঢাকা ও  চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শত শত ওমরাহ যাত্রী আটকা পড়ে।

তৎমধ্যে এহরাম পরিধান অবস্থায়ও ছিল। পরবর্তীতে ২০২০ সালের হজের ক্ষেত্রেও এ করোনা মহামারী বিরূপ প্রভাব এসে পড়ে। যা হজের ক্ষেত্রে বিগত শতবছরের ইতিহাসে চরম বিরূপ প্রভাব বলা যাবে। এর আগেও হজের ইতিহাসে বারে বারে হজ বিঘ্নিত হওয়ার কথা জানা যায়।

বাংলাদেশ থেকে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার নর-নারী ২০২০ সালে হজে গমনের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সচেতন হজযাত্রীর বুঝে আশা স্বাভাবিক করোনা মহামারীর এ দুর্ভোগ হজের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। ২০২০ সাল রমজান সমাগত হলেও সৌদি সরকার হজের ক্ষেত্রে নীরব। রমজান পার হয়ে আরও সময় যাচ্ছিল, কিন্তু সৌদি সরকারের নিরবতা ভাংছে না। অর্থাৎ সৌদি সরকার কিংকর্তব্যবিমুঢ়। হজের ক্ষেত্রে করোনা মহামারীতে সৌদি সরকার হয়ত কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। শেষপর্যন্ত সৌদি সরকার হজের একদম নিকটতম সময়ে ঘোষণা দিল বিদেশ থেকে কোন হজযাত্রী আসবে না।

সৌদি আরবের অভ্যন্তরে থেকে সৌদি নাগরিক ও প্রবাসী নর-নারী নিয়ে হজ পালন করা হবে। এতে সৌদি নাগরিক হতে ৩০% , বিদেশী নাগরিক হতে ৭০%। কিন্তু এ সংখ্যা ১০ হাজার নাকি ১ হাজার এ নিয়ে আমাদের দেশে প্রচার মাধ্যমে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। প্রায় ৩০ এর অধিক ইলেকট্রিক মিডিয়ার অনেকটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তেমনিভাবে প্রিন্ট মিডিয়ায়ও। এক বর্ণনায় ১০ হাজার জন, আরেক বর্ণনায় ১ হাজার জন।

করোনা মহামারীর কারণে হজের এ চরম প্রতিকূলতায় বিদেশীগণের হজে গমন বন্ধ। আমার ক্ষেত্রেও ছবর করা ধৈর্য্য ধরা বাদে গত্যন্তর নেই। তারপরেও সৌদি আরবে হজ নিয়ে কি হচ্ছে জানতে আগ্রহ থাকে। ফলে যতটুকু জানতে পারি সৌদি সরকার নানান শর্ত দিয়ে সৌদি আরবে অবস্থানরত মুসলিম নর-নারীদের পক্ষ থেকে আবেদন করতে আহ্বান জানায়। এতে প্রাথমিক কোটা রাখা হয় ১০ হাজার জন। তৎমধ্যে যাচাই বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ১ হাজার জনকে বেচে নেয়া হয়। তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় তথা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ৫/৬ দিন ব্যাপী হজ করে।

সৌদি টিভিতে হজ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। টিভিতে সম্প্রচার সরাসরি দেখেও মনে হল ১ হাজার নর-নারী হজ করছেন। এক্ষেত্রে হজযাত্রীর বাসে পার্শ্ববর্তী একটি সিট খালি রাখা হয়। অর্থাৎ সরকার করোনার কঠোর নিয়মনীতি মেনে হজযাত্রীগণের হজ করাচ্ছে। পরবর্তীতে সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশের কাউন্সিলর অব হজ তথা হজ অফিসারের সাথে দেশ থেকে মোবাইলে আলাপ হয়। এতে তিনি বললেন, গত বছর ৯ শত ৩৭ জন হজ করেছে। বাকী ৬৩ জন নানা কারণে বাদ পড়া স্বাভাবিক।

গত ১২ জুন সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় জানা যায় চলতি ২০২১ সালের হজেও গত বছরের মত বিদেশ থেকে কোন হজযাত্রী আসবে না। সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে সৌদি নাগরিক ও বৈধ প্রবাসী মিলে ৬০ হাজার জনকে হজের জন্য বাছাই করা হবে। এতে বয়স হবে ১৮ থেকে ৬৫ বছর। সুস্থ শরীরের অধিকারী হতে হবে ও করোনা টিকা নেয়া থাকতে হবে।

যারা গত ৫ বছর হজ করে নাই তারা অগ্রাধিকার পাবে। এখানে কি ৬০ হাজার জন তালিকাভুক্ত হবে, না হজ করবে তা অস্পষ্ট, সময়ই বলে দিবে। বস্তুতঃ হজের ইতিহাসে এ রকম বারেবারে চরম প্রতিকূলতা বিপর্যয় এসেছিল। তবে বিগত ১৩৭ বছরে হজের ইতিহাসে পুনঃ ব্যাপক বিপর্যয় আসল। ১৮ শতকের ১৮৪৬ সালে পবিত্র মক্কায় কলেরা মহামারী দেখা যায়। এতে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ ইন্তেকাল করেন। এ মহামারী দীর্ঘ ৬ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তারপরেও মহামারী শতভাগ উঠে যায়নি। পরবর্তীতে ১৮৫৮ সালে আবারও পবিত্র মক্কায় কলেরা মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এ মহামারী পবিত্র মক্কায় আসে ভারতবর্ষের হজযাত্রীর মাধ্যমে। ভারতীয়দের থেকে অন্যান্য দেশের হজযাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মিসরসহ নিকটতম হজযাত্রীরা দ্রুত দেশে ফিরে যায়। মধ্যখানে বিরতি দিয়ে আবারও ১৮৬৫/১৮৮৩ সালে কলেরা মহামারী দেখা দেয়।

১৯২৫ সালে মিসর থেকে সৌদি আরবে পবিত্র কাবার গিলাফ বহনকারী কাফেলার উপর হামলা হয়। ফলে মিসর থেকে পবিত্র মক্কায় আসা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য ১৯৭৯ সালে হজের ২ সপ্তাহ পর ফজরের নামাজের সময় ধর্মীয় উগ্রবাদী কর্তৃক মসজিদুল হারাম অবরোধ হয়। এ সময় পবিত্র কাবাসহ মসজিদুল হারাম ২ সপ্তাহের জন্য নামাজ তাওয়াফ বন্ধ থাকে। উভয়পক্ষের রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ধর্মীয় উগ্রবাদীরা পরাস্ত হয়। মাত্র ৮/১০ বছরের ব্যবধানে তথা ২০১৪ সালে আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে হজযাত্রী আসা বন্ধ রাখতে হয়। যেহেতু ঐ সব দেশে ইভোলা মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। অবশ্য এতে হজের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েনি। তারও আগে দৃষ্টি দিলে ১৮৩১ সাল থেকে প্লেগ মহামারী দেখা দেয়।

প্লেগ মহামারীর উৎস ছিল ভারতবর্ষ। এখানে থেকে তা সংক্রমিত হয়ে তা পবিত্র মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ৫/৬ বছরের ব্যবধানে ১৮৩৭ সালে আবারও এ প্লেগ মহামারী দেখা দেয়। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত লাগাতার হজের উপর চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। তারও আগে দৃষ্টি দিলে ১০২৬ সালে মূলকে শামের দিকে বিশেষ করে ইরাকের দিকে তীব্র ঠান্ডা ও বন্যার সৃষ্টি হয়, ফলে হজযাত্রী পবিত্র মক্কায় আসা অসম্ভব হয়ে যায়। ১০১৯ সালে মুসলিমবিশ্বে আভ্যন্তরীণ চরম গোলযোগের কারণে মুসলমানগণ মারাত্মক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। একদিকে আর্থিক সমস্যা, অন্যদিকে যাতায়াতে নিরাপত্তা।

অবশ্য ১২৫৬-১২৬১ সাল পর্যন্ত এবং ১৭৯৯ সালের দিকে বিশ্বে নানা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে হজপালনে চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। তেমনিভাবে ১০০০ সালেও মূলকে শাম মিসরসহ ঐসব অঞ্চলে চরম আর্থিক প্রতিকূল ও দুর্ভিক্ষ পরিলক্ষিত হয়। তা নিরাপত্তার অভাবে হজপালনে ব্যাপক প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারও আগে ৯৬৮ সালে আল-মাশারি নামক অচেনা এক মহামারীতে পবিত্র মক্কায় ব্যাপক মানুষ ইন্তেকাল হয়। শুধু তাই নয়, অনেকে হজে গমনের পথেও মারা যায়। রাস্তার প্রতিকূলতায় অনেকে যথাসময়ে পবিত্র মক্কায় পৌঁছতে পারেনি হজের আগে।

এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির তার লিখিত আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে লিখে গেছেন। তারও আগে দৃষ্টি দিলে আব্বাসীয় ও ফাতেমীর রাজনৈতিক দন্ধে তথা সংঘাত আর যুদ্ধের কারণে ঐদিক থেকে হজে গমনে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়, যা ৯৯১-৯৯৩ সাল পর্যন্ত অনেকটা চলমান বলা যাবে। তারও আগে দৃষ্টি দিলে হজের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর হত্যাজজ্ঞ হয় ৯৩০ সালে।

এক কারামতীয়দের নেতা পবিত্র মক্কায় হামলা করে হত্যাজজ্ঞ চালায়। ঐ বিষয়ে ঐতিহাসিক জাহাবী তার তারিখ-আল-ইসলাম গ্রন্থে উল্লেখ করেন। এই উগ্র ধর্মীয় গ্রুপ কারামতীয়দের ভয়ে সে বছর কেউ পবিত্র মক্কায় আসতে পারেননি। তাদের নেতার নির্দেশে তার যুদ্ধারা হজযাত্রীগণকে নির্বিচারে হত্যা করে। সে সময় ৩০ হাজার হজযাত্রীকে হত্যা করে জমজম কূপে ফেলে দেয়া হয়। উদ্দেশ্যে ছিল জমজম কূপ নষ্ট করে দেয়া।

রিয়াদের গবেষণা সংস্থা আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন রিসার্চ এন্ড আকাইদ জার্নালে উল্লেখ করেছে কারামতীয়রা মসজিদুল হারামে লুটতরাজ চালায়। হাজরে আসওয়াদ পাথর নিয়ে বাহরাইনে ফেলে যায়। পরবর্তী সময়ে বড় অংকের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত ১০ বছর যাবৎ হজপ্রথা এক প্রকার বন্ধ থাকে বলা যাবে। তারও আগে ৮৬৫ সালে ইসমাইল ইবনে ইউসুফ আল-সাফাক বাগদাদে আব্বাসীয় সালতানাতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আচমকা আরাফাতের ময়দানে হামলা করে। কয়েক শত হজযাত্রী সেখানে মারা যায়। এতে আতংক ছড়িয়ে পড়লে সে বারের হজপালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।

বস্তুতঃ হজের ইতিহাসে জজিরাতুল আরবসহ মূলকে শাম, মিশর, ইরাক, ইরান এসব অঞ্চলের হজযাত্রীদের সংখ্যা অত্যধিক থাকত। সেকেলে পাল তোলা ছোট ছোট জাহাজ সাগরপথে নিরাপদ ছিল না। স্থলপথেও যুগে যুগে নিরাপত্তার অভাব ছিল। ফলে বিশ্বে অতি দূর-দূরান্ত থেকে হজযাত্রী আসাটা এক প্রকার দূরহ থাকত। বিশ্বে করোনা মহামারী চলমান, জানি না ২০২২ সালে হজের ব্যবস্থাপনায় কি এসে দাঁড়ায়।

লেখক: আহমদুল ইসলাম চৌধুরী প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট