চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আল কুরআনের কয়েকটি বিধি-নিষেধ

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৭ জুন, ২০২১ | ৮:২৪ অপরাহ্ণ

কুরআনুল কারীমের একটি বিখ্যাত ও তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত প্রতি জুমাবার জুমার দ্বিতীয় খুৎবার শেষপর্যায়ে ইমাম সাহেবগণ দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ ও তিলাওয়াত করেন। এ বরকতপূর্ণ আয়াতের মাধ্যমে সাপ্তাহিক মুসলিম সমাবেশে পরওয়ার দিগার আল্লাহর কয়েকটি জরুরী বিধিনিষেধের ব্যাপারে উপস্থিত মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।

আয়াতটি হলো, ইন্নাল্লাহা ইয়া’মুরু বিল আদলি ওয়াল ইহসান ওয়া ই’তায়িজিল কুরবা ওয়া ইয়ানহা আনিল ফাহসা-য়ি ওয়াল মুনকার ওয়াল বাগয়ি’। অর্থ-আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ আর অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন-যাতে তোমরা স্মরণ রাখ (১৬-৯০)। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা তিনটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন- অশ্লীলতা যাবতীয় মন্দ কাজ এবং জুলুম ও উৎপীড়ন ছাড়ো। আয়াতে ব্যবহৃত ছয়টি শব্দের মর্ম নিম্নরূপ- ‘আদল’ অর্থ সমান করা। এর সাথে সম্বন্ধ রেখেই বিচারকদের জনগণের বিরোধ সংক্রান্ত মোকাদ্দমায় সুবিচারমূলক ফায়সালা করাকে আদল বলা হয়। আর যেখানে সুবিচার করা হয় সে স্থানকে বলা হয় আদালত। এ প্রসঙ্গে ইবনে আরবী ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, আদল শব্দের প্রকৃত অর্থ সমান করা। এরপর বিভিন্ন সম্পর্কের কারণে এর অর্থ বিভিন্ন হয়ে যায়। উদাহরণত : প্রথম ‘আদল’ হচ্ছে মানুষ ও স্রষ্টার মধ্যে আদল করা। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার হক-কে নিজের ভোগ-বিলাসের উপর এবং তার সন্তুষ্টিকে নিজের কামনা বাসনার উপর অগ্রধিকার দেয়া। তার বিধান পালন করা এবং নিষেধাবলী থেকে বেঁচে থাকা।

দ্বিতীয় আদল হচ্ছেঃ মানুষের নিজের সাথে আদল করা। তা এই যে, দৈহিক ও আত্মিক ধ্বংসের কারণাদি থেকে নিজেকে বাঁচানো, নিজের এমন কামনা পূর্ণ না করা- যা পরিণামে ক্ষতিকর হয়, সবর অবলম্বন করা ও নিজের উপর বেশি বোঝা না চাপানো। তৃতীয় আদল হলো, সমগ্র সৃষ্টিজীবের সাথে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতিমূলক ব্যবহার করা।  এমনিভাবে বিচারের রায় দেয়ার সময় পক্ষপাতিত্ব না করে সত্যের অনুকূলে রায় দেয়াও এক প্রকার আদল এবং প্রত্যেক কাজে স্বল্পতা ও বাহুল্যের পথ বর্জন করে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করাও আদল। আবু আবদুল্লাহ রাবী এর অর্থ গ্রহণ করে বলেছেন যে, আদল শব্দের মধ্যে বিশ্বাসের সমতা, কার্যের সমতা, চরিত্রে সমতা-সবই অন্তর্ভূক্ত রয়েছে (বাহরে মুহীত)।

‘ইহসান’-এর আভিধানিক অর্থ সুন্দর করা। তা দু’প্রকার। এক. কর্ম, চরিত্র ও অভ্যাসকে সুন্দর করা। দুই. কোন ব্যক্তির সাথে ভাল ব্যবহার ও উত্তম আচরণ করা। ইমাম কুরতুবী বলেন আয়াতে দু’টি অর্থই শামিল করেছে। বিখ্যাত ‘হাদীসে জিব্রাইলে’ স্বয়ং রাসুল (স.) ইহসানের যে অর্থ নির্দেশ করেছেন তাহলো ইবাদতের ইহসান। এর মর্ম ও দর্শন এই যে, আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করা দরকার যেন তুমি তাকে দেখছ। যদি আল্লাহর উপস্থিতির এমন স্তর অর্জন করতে না পার, তবে এতোটুকু বিশ্বাস তো ইবাদতকারীর থাকা উচিৎ যে, আল্লাহ তাঁর কাজ দেখছেন। আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টির বাইরে কোন কিছু থাকতে পারে না। এটাই ইসলামী বিশ্বাসের অন্যতম অঙ্গ।

মোট কথা, আয়াতে ইবাদতে ইহসানসহ কর্ম ও চরিত্রের মাধুর্যকে ইহসান বা সদাচরণ বলে বুঝানো হয়েছে। এছাড়া একজন মুসলমান, অমুসলিম, কাফের, মানুষ ও জীব-জন্তু নির্বিশেষে সকলের সাথে উত্তম ব্যবহার করার বিষয়টি এ আদেশের অন্তর্ভূক্ত। ইমাম কুরতুবী বলেনঃ যার ঘরে তার বিড়াল খাবার না পায়, যার পিঁজরার আবদ্ধ পাখির পুরোপুরি দেখাশুনা না করা হয়, সে যত ইবাদতই করুক ইহসানকারী হিসেবে গণ্য হবে না।

আয়াতে প্রথমে আদল ও পরে ইহসানের আদেশ প্রদান করা হয়েছে। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ আদল হচেছ অন্যের অধিকার পুরোপুরি দেয়া এবং নিজের অধিকার পুরোপুরি নেয়া। তোমাকে কেউ কষ্ট দিলে তুমি তাকে ততটুকু কষ্ট দাও, যতটুকু সে দিয়েছে। পক্ষান্তরে ইহসান হলো অপরকে তার প্রাপ্য অধিকারের চাইতে বেশী দেয়া এবং নিজের অধিকার নেয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি না করা, কিছু কম হলেও মেনে নেয়া। এমনিভাবে তোমাকে কেউ হাত কিম্বা মুখে কষ্ট দিলে তুমি তার কাছ থেকে সমান প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে ক্ষমা করে দাও। সৎ কাজের মাধ্যমে মন্দ কাজের  প্রতিদান দাও। এমনিভাবে আদলের আদেশ হল  ফরয ও ওয়াজিবের স্তরে আর ইহসানের আদেশ হলো মহানুভব চরিত্র ও কর্মের স্তরে (মা’আরিফুল কুরআন)।

(ওয়া ই’তায়িজিল কুরবা’ আয়াতে বর্ণিত তৃতীয় আদেশ)। এর অর্থ হল- আত্মীয়স্বজনকে কিছু দেয়া। কি বস্তু দেয়া তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু অন্য এক আয়াতে তা উল্লেখ করা হয়েছেঃ আত্মীয়কে তার প্রাপ্য দান করা’ (সূরা বণি ই¯্রাইল-২৬)। আর্থিক সেবা করা, দৈহিক সেবা করা, মৌখিক শান্তনা ও সহানুভূতি প্রকাশ করা প্রভৃতি আত্মীয়স্বজনের প্রাপ্যের অন্তর্ভূক্ত। উপরের এ তিনটি ছিল ইতিবাচক নির্দেশ। আর নিম্নের তিনটি হল নেতিবাচক নির্দেশঃ অর্থাৎ আল্লাহ অশ্লীলতা, অসৎকর্ম ও সীমালঙ্গন করতে নিষেধ করেছেন। প্রকাশ্য মন্দ কর্ম বা কথা কে অশ্লীলতা বলা হয়।‘ অসৎকর্ম-এমন কাজ কিংবা কথাকে বলা হয়- যা হারাম ও অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরীয়তবিদগণ একমত। আর ‘বাগয়ি’ শব্দের আসল অর্থ-সীমা লংঘন করা। এখানে জুলুম ও উৎপীড়ন বুঝানো হয়েছে। আ-হযরত (স.) বলেনঃ জুলুম ব্যতীত  এমন কোন গোনাহ নেই যার বিনিময় ও শাস্তি দ্রুত দেয়া হবে।’ আল্লাহ এ দুনিয়াবী জিন্দেগীতেও মজলুমদের সাহায্য করার অঙ্গীকার করেছেন।

আয়াতে যে ৬ টি বিধিনিষেধ রয়েছে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে সুখ-শান্তির অমোঘ প্রতিকার। তাই বর্ণিত আয়াত সম্পর্কে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) বলেছেন: এটি হচ্ছে কুরআনে পাকের ব্যাপকতর অর্থবোধক একটি আয়াত’(ইবনে কাসীর)। হযরত আকসাম ইবনে সাইফী (রাদি.) নামক একজন সাহাবী এ আয়াত শ্রবণ করেই মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন স্বীয় গোত্রের সর্দার। আঁ-হযরতের নবুয়াত দাবী ও ইসলাম প্রচারের সংবাদ পেয়ে তিনি তার কাছে আসার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু গোত্রের লোকেরা বলল আপনি নেতা, গোত্র প্রধান। আপনার নিজের যাওয়া সমীচীন  নয়। এরপর দু’জন লোক মনোনিত করা হল হযরতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য। মনোনিত ব্যক্তিরা মহানবীর (স.) কাছে এসে আরজ করলেনঃ আমরা আকরাম ইবনে সাঈফির পক্ষ থেকে দু’টি বিষয় জানতে এসেছি। প্রশ্ন দু’টি এই: মান আনতা ওয়ামা আনতা- আপনি কে এবং কি?রাসুলুল্লাহ (স.) উত্তর দিলেনঃ প্রথম প্রশ্নের উত্তর এই যে, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল আমি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। এরপর তিনি সূরা নাহলের আলোচ্য আয়াত তথা ইন্নাল্লাহা ইয়া মুরু বিল আদলি ওয়াল ইহসান.. .. ..তিলাওয়াত করলেন। উভয় দূত অনুরোধ জানালেন তা আমাদের  আবার শুনানো হোক। রাসুল (স.) একাধিকবার তিলাওয়াত করলেন। ফলে, শেষ পর্যন্ত আয়াতটি তাদের মুখস্থ হয়ে গেল। দূতদ্বয় আকরামের কাছে ফিরে এসে আয়াতটি শুনালেন। তিনি বললেনঃ এতে বুঝা যায় যে, তিনি উত্তম চরিত্রের আদেশ দেন এবং মন্দ হীন চরিত্র অবলম্বন করতে নিষেধ করেন। তোমরা সবাই তার ধর্মের দীক্ষা নাও, যাতে তোমরা অন্যদের অগ্রে থাক..’ (ইবনে কাসীর)।

লেখক: মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট