চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব

শাহ মাহমুদ হাসান

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১০:৩৮ অপরাহ্ণ

যিনি যে ভাষা তার মায়ের কাছ থেকে জন্মসূত্রে লাভ করেছেন সেটাই তার মাতৃভাষা। পৃথিবীর যেকোনো ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি, মাতৃভাষাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ ভাষা। জাতি ও মানচিত্র ভেদে একেকজন একেক ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজার ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। অঞ্চলভেদে ভাষার পরিবর্তন হয়। ভাষার এই বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের মাঝে রয়েছে মহান আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তার আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদের্শনাবলী রয়েছে।’ (সুরা রুম : ২২)

মাতৃভাষার প্রতি ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসুলগণ স্বজাতির ভাষাভাষী হয়েই প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তাদের প্রতি আসমানি কিতাবগুলো মাতৃভাষাতেই নাজিল হয়েছিল। রাসুলগণের প্রতি প্রেরিত ঐশীগ্রন্থগুলো মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না হলে সেটা জাতি বুঝতে পারত না। ফলে মানুষ পয়গম্বরদের ভাষা না বোঝার দরুন বিভ্রান্তিতে নিপতিত হতো। মাতৃভাষার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত আয়াতে- ‘আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের পরিষ্কার বোঝাতে পারে।’ (সুরা ইবরাহীম : ৪)।

আসমানি কিতাবগুলো যদি যার যার মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না হতো তবে এগুলো নাজিলের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। কেননা এসব আসমানি কিতাব নাজিলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এর মর্ম অনুধাবন করে এর আলোকে জীবন গড়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি আমি কোরআন অনারবদের ভাষায় নাজিল করতাম তবে অবশ্যই বলত এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়নি কেন? এ কেমন কথা, অনারবি কিতাব এবং আরবিভাষী রাসুল!’ (সুরা হ-মিম সাজদা : ৪৪)। আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তো কোরআন আরবিতে নাজিল করেছি এ জন্য যে, তোমরা তা বুঝবে।’ (সুরা ইউসুফ : ২)

দ্বীন ইসলামের পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে মাতৃভাষায় পারঙ্গম হওয়া অত্যন্ত জরুরি। মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধতা ও অদক্ষতা থাকলে জাতিকে সত্যের পথে আহ্বান করা কঠিন। এ জন্য ভাষাগত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে থেকে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আপন পালনকর্তার পথে আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উত্তমরূপে উপদেশ শুনিয়ে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহাল : ১২৫)

মাতৃভাষায় মহানবী (সা.)-এর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ নৈপুণ্যের অধিকারী। তার বাচনভঙ্গিও ছিল অতুলনীয়। তিনি মাতৃভাষায় কথা বলতে গর্ববোধ করে বলতেন, ‘আমি সবচেয়ে বিশুদ্ধ আরবি ভাষাভাষী।’ তার রেখে যাওয়া হাদিসের ভান্ডার এবং মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের ভাষা আরবি সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা ও সাহিত্যের চর্চা এবং তাতে দক্ষতা অর্জন করা নবীদের সুন্নত। আর ইসলামী শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রচার-প্রসার মাতৃভাষা চর্চার ওপরই নির্ভরশীল।

আল্লাহর সমগ্র নিয়ামতের মতো মাতৃভাষার জন্যও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। আর কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হবে বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চায় নৈপুণ্য আনয়ন, পারদর্শিতা ও বিশেষ দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হওয়ার মাধ্যমে। কারণ পৃথিবীর সব ভাষা আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্ট। আর মাতৃভাষা মানবজাতির জন্য আল্লাহর দেওয়া সুমহান নেয়ামত।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশের উপযোগী ভাষা।’ (সুরা রাহমান : ৩-৪)। এই আয়াতের তাফসিরে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, এখানে মানুষ বলতে হজরত আদমকে (আ.) বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাকে সব বস্তুর যথাযথ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। সাত লাখ ভাষাও তার জানা ছিল। (তাফসিরে মাজহারি)। এ আয়াতে মানব সৃষ্টির সঙ্গে ভাষা শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে এবং পৃথিবীর সব ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।

বাংলা ভাষাভাষী মানুষ মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্বকে অনুধাবন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি বাংলা ভাষার জন্য প্রণোৎসর্গ করেছিল। ভাষার জন্য এ আত্মদান ছিল নজিরবিহীন। এ জন্য ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাঙালি জাতির এ ত্যাগকে স্মৃতিবহ করে রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে অফিস আদালতসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, রক্তের বিনিময় অর্জিত ভাষা এখনও সর্বত্র ব্যবহার করা যায়নি। এটা ভাষার প্রতি বড় ধরনের অবহেলা, অবজ্ঞা ও ভাষা শহীদদের অবদানের প্রতি অবমাননাও বটে। অন্য ভাষার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের ভাষার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি। কারণ যে জাতি মাতৃভাষাকে যত বেশি ব্যবহার উপযোগী করতে সক্ষম হয়েছে তাদের উন্নতি ততটাই ত্বরান্বিত হয়েছে।

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট