চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নেপাল ভ্রমণ: পর্ব- ১২

হাফিজা আক্তার

২৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

তৎকালীন সমাজে চর্যাপদের কবিতাগুলো গানের মত করে গাওয়া হতো। বর্তমান কালের বাংলা গানের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চার কলির পরিবর্তে সেকালে ছিল উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ। এগুলিকে বলা হতো ধাতু। এই চারটি ধাতুর মধ্যে উদ্গ্রাহ ও ধ্রুব সব গানেই থাকত, অন্য দুটি বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই একটি ধাতু বর্জিত হলে সেই গানকে বলা হতো ত্রিধাতুক, আর দুটি বর্জিত হলে দ্বিধাতুক। সাধারণভাবে সঙ্গীতকে তখন প্রবন্ধগীত বলা হতো। মোট ২৪ জন কবি এটি রচনা করেন। এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জয়নন্দী, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী। তাঁরা নামের সঙ্গে ‘পা’ (পদ) শব্দটি সম্ভ্রমবাচক অর্থে ব্যবহার করতেন।

ধারনা করা হয়, ২৪ জনের মধ্যে কুক্কুরীপা মহিলা কবি ছিলেন। তিনি পদ লিখেছেন ৩টি। পাওয়া গেছে ২টি। বস্তুতঃ এই বইয়ে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ের বাংলার সামাজ-সংস্কৃতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে উঠে আসে বৌদ্ধধর্মের আড়ালে। যেমনঃ একটি কবিতায় এক দুঃখী কবি তাঁর সংসারের অভাবের ছবি এঁকেছেন এভাবেঃ “টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী। হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।। বেঙ্গ সংসার বডহিল জাঅ। দুহিল দুধ কি বেন্টে ষামায়।।” (অর্থ: টিলার ওপরে আমার ঘর, আমার কোনো প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে আমার ভাত নেই, আমি প্রতিদিন উপোস থাকি। বেঙের মতো প্রতিদিন আমার সংসার বেড়ে চলেছে, যে-দুধ দোহানো হয়েছে তা কি আবার ফিরে গাভীর বাঁটে।)
চর্যাপদে কিছু প্রবাদ বাক্য এখনোও আমরা লেখালিখি বা কথায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করি। এগুলো হলো: আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী (হরিণের মাংসই তার জন্য শত্রু—কবি ভুসুকুপা, ৬ নং পদ), বর সুন গোহালী কিমু দুঠ্য বলন্দেঁ (দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো-কবি সরহপা, ৩৯ নং পদ)।

 

প্রেম-ভালোবাসা এ যুগে শুধু আমরাই করি? জ্বী না। বর্তমান সমাজের প্রেম-ভালোবাসা দেখে গেল গেল বলে যারা মার্ক জাকারবার্গ-এর পিন্ডি চটকান তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি ১০০০ বছর পূর্বে যখন এই ফেসবুক ছিল না তখনও কিন্তু ছিল। বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে এই দেখুন চর্যাপদে কি লেখা আছেঃ হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী (হাড়িতেঁ ভাত নেই, অথচ প্রতিদিন প্রেমিকেরা এসে ভীড় করে—কবি ঢেগুণ পা, ৩৩ নং পদ) বা পদ ২৮– উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।
শুধু কি তাই? বিবাহ উত্তর নর-নারীর প্রেম যা বর্তমানে আমরা রাগের বশে বলি পরকীয়া। সেই পরকীয়া? চর্যা-২-এ কবি কুক্কুরীপার কবিতার কয়েকটি চরণ-
দিনে বধূ কাকের ডরে কাঁপে,
রাতদুপুরে সে-ই ছোটে কামরূপে!
কুক্কুরীপার চর্যা এমনই যে
কোটির মাঝে একজন তা বোঝে।
“সে দিনের বেলায় কাকের ডাকে ভয় পায়, কিন্তু রাতে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যায়।”
তবে হ্যাঁ, বিবাহ উত্তর নর-নারীর প্রেম এই বাংলায় ক্ষীণ ধারায় প্রবাহমান ছিল। এটাকে মোটা দাগে জাতীয়করণ করেছে মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক নয় প্রয়াত শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। প্রাচীন গৌঢ়, রাঢ় শাসক থেকে হাল আমলের শাসকদের মধ্যে তিনি এইদিক দিয়ে ছিলেন চরম ব্যতিক্রম। তথাস্তু নর-নারীর প্রেম ভালোবাসা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত হৃদয়ের প্রবাহমান একটি ধারা। কাগজ-কলম-দোয়াত-তালপাতা-টাইপরাইটার বা হালের ফেসবুক এই ধারা সৃষ্টি করতে পারে না। জড় বস্তুকে এত ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা দেননি। এগুলো শুধু প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে যুগে যুগে কালে কালে। যেমনঃ কোরআন শরীফের একটি আয়াত, “তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয় চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন আছে”–(৩০:২১)।

যাহোক, দরবারে ফিরে আসি। অনেক ঐতিহাসিক শিলালিপিও সযত্নে রক্ষিত ছিল এই দরবারেই। কারণ নেপালের রাজবংশ টিকে ছিল দীর্ঘদিন। এই তো সেদিন কয়েক বছর আগে নেপালের জনপ্রিয় রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ১ জুন, ২০০১ তারিখে নৈশভোজনরত অবস্থায় আকস্মিকভাবে তাঁর সন্তান যুবরাজ দীপেন্দ্রের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান। সাথে রাণী ঐশ্বরিয়া, প্রিন্স নিরাজন, প্রিন্সেস শ্রুতি এবং রাজপরিবারের আরও পাঁচজন সদস্য নিহত হন। এরপর ভবিষ্যতের রাজা দীপেন্দ্রও আত্মহত্যা করেন। শুধুমাত্র বীরেন্দ্রের ভাই জ্ঞানেন্দ্র ছাড়া রাজপরিবারের আর কেউ ছিল না। ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, যুবরাজ দীপেন্দ্রের ভবিষ্যত বঁধুকে তার পরিবার কোনক্রমেই মেনে নিতে পারছিলেন না বলে নেশাসক্ত অবস্থায় দীপেন্দ্র এটি ঘটান। পরবর্তীকালে রাজা হন জ্ঞানেন্দ্র। কিন্তু রাজা হলে কি হবে জ্ঞানেন্দ্রের মাথা কোয়াটার নষ্ট ছিল, তাঁর বউয়ের ছিল হাফ আর তার পুত্রের ছিল শতভাগ নষ্ট। মাথা নষ্ট হলে যা হয় যেখানে চুপ থাকার কথা সেখানে দেন চিৎকার আর যেখানে চিৎকার দেয়ার কথা সেখানে তিনি নাকে সর্ষে তেল দিয়ে ঘুমান। এদিকে প্রিয় রাজার আকস্মিক ট্র্যাজেডিতে শোকে মুহ্যমান নেপালি জনগন উপরের কাহিনিটি বিশ্বাস না করে এটিকে বরং প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হিসেবে মনে করতে থাকে। কারণও ছিল।

সিংহাসনে বসার পর রাজা জ্ঞানেন্দ্র গণহত্যার বিস্তারিত তদন্ত করতে না দিয়ে বরং গণহত্যার স্থান ত্রিভুবন সদন ধ্বংস করে ফেলেন। তারপর শোক, গুজব আর তাঁর পরিবারের মাথা নষ্ট কান্ড-কারখানা দেখে মাথা গরম নেপালিদের মাথা শুধু গরমই নয় রীতিমত বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরিত জনগন রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে শুধু সিংহাসন ছাড়াই করেনি দরবার ছাড়াও করছিল। ১১ জুন ২০০৮ সালে তিনি সপরিবারে বনবাসে চলে যান। তিনি নাকি এখন নিভৃতে চোখের পানি ফেলেন আর বলেন এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল না। নেপালিরা তাঁকে ভুল বুঝেছে। সময় গেলে সাধন হয় নারে পাগল। সাধন হয় না। এটি কয়েক শত বছর আগেই বলে গেছেন আমাদের লালন শাঁই। বস্তুতঃ এরপর থেকে নেপালের সকল রাজদরবার জনগনের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয় আর দর্শণীয় স্থান হিসেব উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। ভাবনা থেকে ফিরে আবারও চারপাশে চোখ বুলালাম প্রিয়জনদের জন্য কিছু কেনার নিমিত্ত। কিন্তু বিধি বাম কেনা-কাটার মত কিছুই দেখছি না। ইতিউতি করে গিয়ে ঢুকলাম একটি মালা-চুড়ির দোকানে।

পূর্বকোণ/টিএফ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট