চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

নেপাল ভ্রমণ: পর্ব- ০৮

হাফিজা আক্তার

২৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ৬:১৮ অপরাহ্ণ

যেহেতু রোজা, তাই রুমে বসে রইলাম। আয়োজক থেকে একজন কারণ শুধাল। বললাম। কাচুমাচু হয়ে মৃদু স্বরে বলল, “চা-পানীয়ও নয়।” হেসে বললাম, “তাও নয়”। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর এসে বলল, “তুমি কি নামাজ পড়তে চাও? এখানে নামাজের রুম রয়েছে”। বাড়তি যোগ করল, “তোমাদের কি সফররত অবস্থায় রোজা অবশ্যম্ভাবী”। তথাস্তু। এবার আমি চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইলাম। আমার ধারণা ছিল নেপালের মানুষ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানে না। কারণ এখানে মুসলিমরা সংখ্যায় হাতে গোনা। যেখানে বিশাল সংখ্যক মুসলমান অধ্যুষিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারতে এসব দেখিনি বা প্রসঙ্গ অনুপস্থিত ছিল। তাছাড়া মুসলিমদের প্রতি তাদের বৈষম্য-নির্মমতা-দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ে যেসব সংবাদ প্রতিনিয়ত ভেসে আসে তা অকল্পনীয় আর বিভৎস।

চা বিরতির পর আবার সেশন। আফগানিস্তান থেকে বার্মা পর্যন্ত বিশাল আর বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে থাকা পৃথিবীর দীর্ঘ পর্বতমালা হিন্দুকুশ-পামির-কৈলাশ-হিমালয় নিয়ে চলল নানা আলোচনা এবং উপস্থাপনা। চলল মধ্যাহ্ন বিরতির আগ পর্যন্ত। ঘড়ি ধরে ঠিক একটায় মধ্যাহ্ন-ভোজন। সবাই মধ্যাহ্ন-ভোজনে গেল ICIMOD Cantine-এ। এবারও আহারে যোগ না দেওয়াতে বিশাল হল রুমে একা হয়ে গেলাম। মধ্যাহ্ন-ভোজন দীর্ঘ সময় নিয়ে হবে আর এভাবে একা বসে থাকলে দৃষ্টিকটু দেখাবে বিধায় ICIMOD Campus একটু ঘুরে দেখার জন্য বের হলাম। সদ্য বৃষ্টি ধোঁয়া ক্যাম্পাস কেমন সবুজাভ আর জলে সিক্ত কমল। কোথাও ধুলো ময়লা নেই। একেবারে ব্র্যান্ড নিউ লুক। ICIMOD-এর স্থাপত্য নকশা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। পুরনো স্থাপত্য ধাঁচের ইউরোপিয়ান আর এশিয়ান মিশেলে এক অনন্য সুন্দর নকশায় গড়া। সুন্দর ফুল বিন্যাস পুরোটা ক্যাম্পাস জুড়ে। অবাক করা বিষয় ছিল তিনটি। প্রথমত: বিশাল এলাকা নিয়ে সরি সারি সৌরবিদ্যুতের প্লেট। দ্বিতীয়তঃ গ্রাউন্ড থেকে বিদ্যুত প্রবাহ নিয়ে লনে বৈদ্যুতিক বাল্ব সংযোগ। এটা একেবরে আমার কাছে নতুন। তৃতীয়তঃ ঠিক মেইন বিল্ডিং-এর সামনে ঢোকার পথের দু’পাশের একপাশে একটি বট আরেক পাশে অশ্বত্থ গাছ বেদীতে বাঁধিয়ে লাগানো। এরকম একটি অত্যাধুনিক স্থাপত্যের সামনে ভাবা যায় না। বট-পাকুর-অশ্বত্থ মত গাছ খালি জায়গা পেলে জোর করে উঠে পরে। কিন্তু যত্ন-আত্তি করে লাগানোর কিছু না। যাহোক এদের দুজনেরই এখন কিশোর বয়স। পূর্ণ বয়ষ্ক হলে স্বাস্থ্য আর লম্বা-চওড়ায় কেমন হবে কে জানে?

তারপর চোখ পড়লো কিছু নীল রং এর ফুলের দিকে। মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে নীলাভ আভায়। কাছে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখলাম নীল জাকারান্দা ফুল। ফুল হাতে আমি আনন্দে বিহ্বল। সাথে সাথে কিছু ছবি নিয়ে নিলাম। বলতে দ্বিধা নেই যে আমার নেপাল ভ্রমণের সবচেয়ে এক্সাইটিং পার্ট হচ্ছে জাকারান্দা বা Jacaranda গাছ, ফুল নিজ চোখে দেখা, ছবি তুলতে পারা। এই গাছ নিয়ে বিশ্বে বেশ মাতামাতি হয়। যেমনঃ উন্নত নগর সাজানোতে, ফটোগ্রাফি, পেইন্টিং, বিভিন্ন পোষাক-পর্দা-সিরামিক দ্রব্য….ব্লা..ব্লা-তে Jacaranda গাছ-ফুলের নকশা থাকে। অনেক পিকনিক বা আউটিং স্পট বা দূরতম পাহাড়ের ঢালে এই গাছ বুনে দেয়া হয় নান্দনিকতার জন্য। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় উন্নত নগরগুলোর রাস্তার দু’পাশে। ঐতিহাসিকভাবে এটার আদি নিবাস নাকি দক্ষিণ আমেরিকার বিশেষ করে উষ্ণমন্ডলীয় জলবায়ু অঞ্চলে। তবে উপনিবেশিক যুগে এটা অষ্ট্রেলিয়া ও উষ্ণ ইউরোপীয়ান নগর সাজাতে গাছটি আনা হয় আদি ভূমি থেকে। Jacaranda উদ্ভিদের Bignoniaceae পরিবারে অন্তর্ভূক্ত। উক্ত পরিবারের চারটি উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে একটি প্রজাতি Jacaranda নামে ব্যাপক পরিচিত। Jacaranda আবার অনেকগুলো প্রজাতিতে বিভক্ত রং, আকার বা পাতার ধরনের উপর ভিত্তি করে। তবে তিন ধরনের Jacaranda গাছ বর্তমান বিশ্বের নগরের রাস্তা সাজানোতে বিশেষ পরিচিত।যথাঃ ১) Jacaranda Mimosifolia বা নীল জাকারান্দা, ২) Jacaranda Arborea বা গাঢ় বেগুনী জাকারান্দা ৩) Jacaranda Copaia রং অনেকটা বেগুনী আর মেজেন্টার মিশেল। তিন ধরনের মধ্যে নীল জাকারান্দা সৌন্দর্য আর জনপ্রিয়তায় শীর্ষে। মজার বিষয় হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে একমাত্র নেপালেই নাকি জাকারান্দা বিশেষ করে নীল জাকারান্দা ব্যাপকভাবে নগরগুলোর রাস্তার ধারে, মাঠে, উঠানে, পার্কে বা পাহাড়ের ঢালে রোপন করা হয়েছে নান্দনিকতার জন্য। আমি এই নীল জাকারান্দা দেখেছি কাঠমান্ডুতে একেবার ঋতুর শেষে এসে। গাছে আর গাছের তলায় অল্প বিস্তর ছড়িয়ে ছিল। তাতে কি? কিছু তো ছিল দেখার জন্য। আচ্ছামত ছবি তুলে আর পরাণ ভরে পুরো এলাকা দেখে মধ্যাহ্ন বিরতি পুরোটা খরচ করে আবার এসে বসলাম সভাকক্ষের তৃতীয় সেশনে। দারুণ সব উপস্থাপনা আর আলোচনা-সমালোচনা। বিভোর হয়ে শুনছি কখনো অংশগ্রহন করছি।

এরই মাঝে অনুষ্ঠানের ফাঁকে আরেকজন ICIMOD-এর অফিসিয়াল আমার কাছে এসে বললো, “নেপালের ইফতার টাইম সন্ধ্যা ৭:০০টায়। তোমার জন্য ইফতার থাকবে।” তথাস্তু।  ইফতারের আগে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬:০০টায় যারা রোজদার নয় তাদেরকে পানীয় আর স্ন্যাক্স দিয়ে আপ্যায়িত করে ৭:০০টায় মেইন অফিসিয়াল ডিনার শুরু করলাম রোজাদার আর বে রোজদার সকল ধর্মের প্রতিনিধিরা একসাথে। আমরা মুসলিমরা সম্মানিতবোধ করলাম তাদের আচরণে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং দু’একজন উপজাতীয় ধর্মাবলম্বী। বলে রাখি ICIMOD স্থাপত্যটির স্থপতি BUET-এর একজন বাংলাদেশী। অনুষ্ঠানটির অফিসিয়াল গালা ডিনারে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে হাস্যোজ্জ্বলভাবে এই তথ্যটি জানিয়েছিলেন। আরো বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটির নকশা করা হয়েছিল ইউনেস্কোর প্রাচীন Heritage-এর নকশায়। অন্যান্য দেশের প্রতিনিধি এবং ICIMOD-এর সবার সামনে আমরা দুজন বাংলাদেশী সম্মানিতবোধ করি। এভাবেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।

পূর্বকোণ/টিএফ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট