চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নেপালভ্রমণ : পর্ব-৬

হাফেজা আক্তার

১৩ অক্টোবর, ২০১৯ | ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

আমি বুঝতে পারছি মেয়েটি অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আর উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। কোনমতে বললাম, “রুমে গিয়ে ইন্টারকমে কি বলা যাবে?” তাৎক্ষণিক বলল, “অবশ্যই যাবে, তবে প্লিজ, বলতে দেরি করো না। দেরি হলে আয়োজনে কষ্ট হবে”। “ঠিক আছে” বলে রুমে চলে আসলাম আর ভাবছিলাম চারিদিকে কেউ মসজিদে কেউ গির্জায় কেউ মন্দিরে সিরিজ বোমা ফেলছে আর কাতারে কাতারে প্রার্থনারতরা মরছে বিশ্বের কোথাও না কোথাও। মরার পর যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী শোক বার্তা বা ব্যবস্থা।

বিশ্বে যার শক্তি যত বেশী তার হুঙ্কার তত তীব্র। ভাবখানা এরকম এই হুঙ্কার তর্জন গর্জন যেন মানবতার জন্য নয় নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার নিমিত্তে ভয় আর আক্রোশের হুঙ্কার। আচরণও কেমন আজিব গোছের হয়ে যাচ্ছে দেশ আর জাতি ভেদে ধর্ম থেকে ধর্মান্তরে। কেউবা পরম ভক্তি ভরে গোমূত্র পান করছে বা বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। কেউবা গরুর মাংস খাওয়ার বা বিক্রি বা শুধুমাত্র রাখার অপরাধে বা তিনটির যেকোন একটির গুজবে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। কারো বোরকা বা হিজাব জনপথে টেনে খুলে ফেলা হচ্ছে বা যারা এগুলো পড়ছে তাদের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে বের করে দিচ্ছে। আবার কেউ ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর বিচার হালকা করা হচ্ছে মেয়েটি হিজাব বা বোরকা পরতো কি পরতো না তা দিয়ে বা তার পোষাক বা ফেসবুকে তার সেলফির সংখ্যা বা ধরণ দিয়ে। শুধু এই কারণেই দেশে দেশে জাতি ভেদে কারো ঘর-দোর-ভিটা-মাটি-ব্যবসা-যুবতী কণ্যা/জায়া/জননীকে ভোগদখলের চেষ্টা চলছে। আমার একবার আজব অভিজ্ঞতা হয়েছিল ঢাকা থেকে বহুদূরে দেশের দক্ষিণের এক কলেজে শিক্ষকতার সময়ে। সেখানের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাত্রী হোস্টেলের পাশে কলেজের একটি গেষ্টরুমে আমার আবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে কলেজের অনেক ছাত্রীর সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তার মধ্যে প্রিয়াংকা ছিল একজন। কথায় মনে হলো সে হিন্দু ধর্মের। একদিন কলেজ থেকে রুমে ফিরছি দেখি সে বোরকা পড়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি কি মুসলিম”? সে হেসে বলল, “না, মেডাম। আমি হিন্দু”। “তবে যে বোরকা পরে আছো?” প্রিয়াংকার পাল্টা মৃদু উত্তর ছিল, “Security-এর জন্য পরি”। তাৎক্ষণিক ফ্ল্যাশব্যাক করলো সুদূর অতীতে।

আমি তখন স্কুলের প্রাইমারিতে অধ্যয়ণরত। আব্বা অফিস থেকে চার নাকি ছয় মাসের ট্রেনিং-এ ফ্রান্সের প্যারিসে। আমরা তখন নানার বাড়ির লাগোয়া আমাদের সদ্য নির্মিত বাড়িতে আছি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে। একে তো বাবা নেই তাই শাসনের কড়াকড়ি নেই তার উপর নানাবাড়ি। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে তখন অনেক হিন্দু পড়শী ছিল। আর ছিল বড় বড় পুকুর-দিঘী। কারণ হলো হিন্দুরা স্নানের আগে বা পরে পুকুর বা দিঘীতে সূর্যকে প্রণাম করত বা সূর্য পূজা করত। বলে রাখি, আমাদের তখন স্কুল ছিল সকাল ১০:৩০ থেকে ২:৩০ পর্যন্ত বা কাছাকাছি সময়ে। যেহেতু শাসনের বাড়াবাড়ি নেই তাই স্কুলের যাওয়ার আগে প্রায় ঘন্টা খানিক আর ছুটির দিনগুলোতে আরো বেশী সময় ধরে পুকুর বা দিঘীতে গোসল করতাম চোখ লাল হওয়া আর চামড়া খরখরে হওয়া পর্যন্ত। সাথে থাকত সমবয়সী ভাই বোন প্রতিবেশী বন্ধুরা আর হিন্দু পরিবারের মাসী-পিসী-দিদি-বৌদিরা মানে বিভিন্ন বয়সী মেয়েরা। সব ধর্মের বয়স্ক ছেলেরা একটু তফাৎ রেখে গোসল বা স্নান করত। গোসল হয়ে গেলে পর ভেজা কাপড়ে মেয়রা খালি পায়ে রাস্তা পার হয়ে যার যার বাড়িতে গিয়ে কাপড় পাল্টাতো। শুধুমাত্র ছেলেরা পুকুর বা দিঘীর পাড়ে পাল্টাতো। এটা তখনকার সময়ের একটি স্বাভাবিক দৃশ্য। যে রাস্তা দিয়ে ভেজা কাপড়ে মেয়েরা হেঁটে বাড়িতে ফিরতো সেই একই রাস্তা ধরে গ্রামের কৃষক বা খামারি বা গেরস্থরা বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করে ত্রস্থপায়ে বাড়ি ফিরত। কাউকে দেখিনি কিছু বলতে বা তাকাতে। তাদের দেখলে মনে হত বাড়িতে তাদের মেলা কাজ পড়ে রয়েছে। এক্ষুণি ফিরতে হবে নইলে সর্বনাশ। লম্বা লম্বা পা ফেলে মাথা নিচু করে ঝাকি/লোটা/বালতি/ঝুড়ি বা যার যেমন থাকত তা নিয়ে হেঁটে যেত। বা কখনো শুনিনি কেউ কারো কাছে অভিযোগ করছে বা আড়ালে ফিসফিস করছে বা বাৎসরিক কোন ওয়াজ মাহফিলে হুজুররা বয়ান দিচ্ছে মেয়েরা পুকুরে বা দিঘীতে গোসল/স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে তাই সমাজে ছেলেদের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে/যাচ্ছে/যাবে। অথচ নানাবাড়ির পাশে ছিল তৎকালীন এক দারোগার বাড়ি আর তার পাশে বিশাল বাড়ি নিয়ে থাকতেন শহরতলির কোন এক গ্রামের চেয়ারম্যান রমজান খাঁ। তাদের প্রত্যেকেরই জোয়ান সোমত্ত ছেলে ছিল। আমরা মামা বলে ডাকতাম। অথচ এই যে কারো মাথা নষ্ট হচ্ছে না এটাকেও আমার কাছে তখনকার একটি সাধারণ ব্যাপার মনে হত। আজ এই সংস্কৃতি কি কোথাও আছে? জানি না। না থাকলেই স্বস্তি। তথাস্তু ধর্ম পালন করা বা না করা একজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এখন দেখা যায় এটা পালন না করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এমনকি সে পালন করছে তারপরও কতটুকু সঠিকভাবে করছে বা না করছে এটা নিয়ে বিচার সালিশ বা চরিত্রহীন বা জাহান্নামী তকমা দেয়া নেয়া নিয়ে সমাজ পেরেশান। যাহোক ভাবনা থেকে ফিরে ফোন দিলাম রিসিপশনে। অনুরোধ করলাম wake up call, সেহেরী টাইম এবং পছন্দের মেনুর বিষয়ে। তারপর বিছায় শোয়া মাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। জীবনে প্রথমবার কোন হোটেলে এত নিবিড় ঘুম ঘুমালাম। আর ঘড়ির কাঁটা ধরে সেহরীর যাবতীয় সার্ভিস বুঝে পেলাম। তখনও ভাবনা মাথা থেকে যাচ্ছে না। আচ্ছা কেউ যদি আমাদের দেশের ছোট বড় কোন হোটেলে বলত যে আমাদের উপোসের থালা বা দেবীর প্রণামের থালা সাজিয়ে দাও। এই রাত দুপুরে কেউ কি দিত? পাগল মন, মন রে, মন কেন এত কথা বলে। সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য এগুলো মানুষের মনে-হৃদয়ে-মস্তিষ্কে থাকে। সময় সুযোগে এগুলোর প্রকাশ পায় মানুষের আচরণে। এটা যার যার বিষয়। বইয়ে দু’কলম পড়ে এগুলো বোঝা বা প্রকাশ করা সম্ভব না।

 

 

 

 

 

টি/এফ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট