চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভারত ভ্রমণ : শিকড়ের খোঁজে

নাওজিশ মাহমুদ

১১ আগস্ট, ২০২৪ | ১২:১০ অপরাহ্ণ

আসামের বাঙালি আজকে বির্পযস্ত ও বিভ্রান্ত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের দায় ভোগ করছে তারা। অথচ এই দেশভাগে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছে। অসমিয়াদের করুণার উপর টিকে থাকতে হচ্ছে। ১৮২৬ সালে বার্মাার কাছ থেকে আসাম দখল করার পর আসামকে বেক্সগল প্রেসিডেন্সির সাথে সংযুক্ত করে। ১৮৩৬ সালে আদালতে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে আসামে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা চালু ছিল। ১৮৭৪ আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়ার সময় রাজস্ব এবং শিক্ষিত ও দক্ষ জনবলের অভাব পূরণের জন্য বাংলার দুটি সমৃদ্ধ জেলা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়া ও সুরমার উপত্যকার সিলেট ও ব্যারাক উপত্যকার কাছাড় জেলাকে আসামের সাথে জুড়ে দেয়। তখন অসমীয় ভাষা ছিল বাংলা ভাষার উপভাষা। কিন্তু অসমিয়াদের বাঙালির সাথে নৃতাত্তি¡ক ভিন্নতায়, অসমীয়রা এই বাংলার উপভাষা অসমীয় ভাষাকে ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে। অসমীয় ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দাবি জানায়। এই আন্দালনের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে থাকা বাঙালি ও বাংলাভাষা। কারণ ব্রিটিশ প্রশাসনে অধিকাংশ রাজকর্মচারি ছিল বাঙালি। আসামে ১৯২১ সালের আদশুমারীতে ৬৭% ছিল বাঙালি। এক জাতিত্ত্ব ও দ্বিজাতিতত্ত্বের লড়াইয়ে বাঙালিত্বের বদলে হিন্দুত্ব এবং মুসমানিতে¦র দ্ব›দ্ব ও সংঘাতের অভিশাপ ভোগ করছে এই অঞ্চলের মানুষ। তখন যদি দূরদর্শী চিন্তাচেতনা দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে ভিত্তি করে সামষ্টিকভাবে এগিয়ে আসতো এবং বাঙালি ঐক্যবদ্ধ থাকতো, তাহলে আসামের বাঙালিদের আজকের এই পরিণতি ভোগ করতে হতো না। আসামে শিক্ষায়-দীক্ষায়, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে বাঙালি ছিলো এগিয়ে। স্বাভাবিকভাবে বাঙালি ও বাংলা ভাষা হয়ে উঠে অসমীয়াদের আক্রমণের প্রধান শিকার। দেশভাগের পর আসামে হিন্দ-মুসলমান দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সাথে যোগ হয় অসমীয়াদের সাথে বাঙালির ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব ও সংঘাত।

 

১৮৭৪ সােেল অহমীয় ভাষাকে সরকারি ভাষার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তখন থেকে শুরু হয় বাংলাভাষার সাথে অহমীয় ভাষার সংঘাত। সরকারি ভাষা হিসেবে অসমীয ভাষার অন্তুর্ভুক্তি বাংলাভাষা হয়ে উঠে অসমীয়াদের চক্ষুশীল। তবু সুরমা উপত্যকার সিলেট ও ব্যরাকা উপত্যকার কাছাড় জেলায় এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়ায় আসামের সাথে সংযুক্ত থাকায় আসামে বাঙালিরা অসমীয়াদের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় পরিস্থিতি ভারসাম্য বজায় ছিল। তখন ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলমানের সংঘাতে বাঙালি ও অসমীয় সংঘাত খুব একতটি মাথাছাড়া দিয়ে উঠেনি। তখন সিলেটে হিন্দু-মুসলমান প্রায় সমান থাকলেও গোয়ালপাড়া ছিল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। এই গোয়ালপাড়ার উঠা বসা ও যোগাযোগ সবকিছু ছিল রংপুর এবং ময়মনসিংয়ের সাথে। আসামের সাথে সংযুক্ত হওয়ায় গোয়ালপাড়া তার মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গোয়ালপাড়ার সাথে সুরমা অঞ্চল সিলেট ও কাছাড় জেলার ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে ভাষা ও সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়াও সম্ভব হয়নি। বাঙালি সংস্কৃতির মেলবন্ধনও ঘটেনি। ফলে সুরমা উপত্যকা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং আসামের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হয়। ফলে বাঙালি সংস্কৃতির কোন সমষ্টিগত চেতনা এই অঞ্চলে বিকশিত হয়নি। অখন্ড বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে বাংলার অবিভাজ্য সংস্কৃতি, ভাষা ও রাজনীতি থেকেও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে গোয়াল পাড়াতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা একচেটিয়া হওয়ায় কলকাতা হিন্দু মধ্যবিত্তের প্রভাবের ঘাটতি থেকে যায়। সেই সাথে ঘাটতি থেকে যায় বাঙালি সংস্কৃতির। অপরদিকে সুরমা ভ্যালি ও ব্যারাক ভ্যালি হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রায় সমান সমান হওয়ায় হিন্দু মধ্যবিত্তে কলকাতার মধ্যবিত্তের বাঙালি সংস্কৃতি স্রোত অব্যাহত থাকে। যা সিলেট মুসলমানদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। শিলং অবিভক্ত আসামের রাজধানী থাকায় সিলেট ও কাছাড় জেলার অধিবাসীগণ এই সুবাধে সর্বক্ষেত্রে আলোকিত হয়ে উঠে।

 

১৯৩৭ সালে একজন মুসলমান সাদুল্লাহ আসামের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় মুসলিম লীগ নেতাদের উদাসীনতায় গোয়ালপাড়া আসামে থেকে যায়। আসামের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে সিলেট গনভোট অনুষ্ঠিত হলেও আশ্চর্র্যজনকভাবে গোয়ালপাড়ায় কোন গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় গোয়ালপাড়ার সংখ্যগরিষ্ঠ জনগণ ছিল মুসলমান। সিলেটে হিন্দু মুসলমান প্রায় সমান সমান থাকায় হয়তে গণভোট দিয়ে নিষ্পত্তি করতে হয়েছে কিন্তু গোয়াল প্রায় একচেটিয়া মুসলমাল অধ্যুষিত হলেও সেখানে বিনা গণভোটে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার কথা। অন্ততপক্ষে সিলেটের মত গণভোট দিয়ে হলেও গোয়ালপাড়ার জনগণের মতামত নেয়া যেত। গণভোটে রায় পাওয়া সত্তে¡ও করিমগঞ্জ আসামে অর্ন্তভুক্ত হয়। করিমগঞ্জ ও গোয়ালপাড়া তখন পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হলে আজকে বাংলাদেশের অংশ হয়ে উঠতো। বাঙালির বৃহৎ অংশ আজকের জটিলতার কিছুটাও হলে লাঘব হতো। হিন্দু-মুসলিম জটিলতা বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে মিমাংশার সুযোগ থাকতো। কিন্তু বর্তমানে আসামে হিন্দ-মুসলিম ও অসমীয়-বাঙালি জটিলতার মতো অসমাধানযোগ্য সমীকরণে রূপান্তরিত হতো না। কাছাড় জেলা আসামের সাথে থাকবে, না পাকিস্তানে আসবে সে জন্য একটা গণভোটের আয়োজন করা হলে, আজকে না হয় বলা যেত, তারা ভোট দিয়ে তাদের বর্তমান দুর্দশা ডেকে এনেছে।

 

১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে যে বঙ্গভক্সগ হয়েছিল, তাতে সিলেট, কাছাড় জেলা এবং গোয়ালপাড়া জেলা আবার বাংলার একাংশের সাথে ভৌগোলিকভাবে সংযুক্ত হয়। বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলাভাষা বিকাশের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। যদি ১৯০৫ সালের বক্সগভঙ্গে বিরুদ্ধে আন্দোলন না হতো, তা হলে কলকাতা ভারতের রাজধানী থেকে যেত। তখন কলকাতাকে কেন্দ্র করে সারা ভারতের রাজনীতি আবর্তিত হতো। ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগের রাজনীতি ও পরিণতি ভিন্নভাবে হতো। আসামের বাংলাভাষী হিন্দু-মুসুলমান পাকিস্তান রাষ্ট্রে অর্ন্তভুক্ত হতো। তা হলে হয়তোবা বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করার সুযোগ পেত। অথবা গোয়ালপাড়া, সিলেট ও কাছাড় (শিলচর) জেলা বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ হয়ে উঠতো। বৃহত্তর আসামের সপ্তকন্যাসমূহ খ্রিষ্টান, হিন্দু, মুসলিম, বাঙালি, অসমীয় এবং সপ্তকন্যার আদিবাসী জাতিসমূহ নিয়ে একটি নতুন সমীকরনে নিষ্পত্তি হতো। পূর্ব বাংলা ও আসামে প্রদেশের ভাষা হয়ে উঠতো বাঙলা এবং তার সহোযাগী হিসেবে অসমীয় ভাষা ও সাথে অন্য সংখ্যালঘু ভাষাসমূহ সমন্বিত হতো। বাঙালির অভিবাজ্যতা রক্ষার জন্য বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করলেও বাঙালি অধ্যুষিত গোয়ালপাড়া, কাছাড় (শিলচর) জেলা ও পূর্ণীয়া জেলাকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ১৯১১ সালে বাঙালিকে সংকুচিত করার প্রক্রিয়া হাতে নেয় ব্রিটিশরা। তার সফল পরিণতি ঘটে ১৯৪৭ সালে। তারই জের টানছে এই শিলচরের বাসিন্দারা। কলকাতার মধ্যবিত্তে প্রভাবিত বাঙালির এক অংশ ১৯০৫ সালে বাংলা বিভক্তির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে তোলে, তার প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশরা কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে। বাঙলাভাষা ভিত্তিক প্রদেশ গঠন করে। বাংলাভাষী সিলেট জেলা, কাছাড় জেলা ও গোয়ালপাড়া জেলাকে আসামের সাথে জুড়ে দেয়। এই তিন জেলায় তাদের রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বাংলার মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে দেশভাগ হলে শুধু মাত্র সিলেটের বৃহৎ অংশ পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। গোয়ালপাড়া, করিমগঞ্জ ও কাছাড় জেলা আসামের সাথে সংযুক্ত হয়। সিলেট সহ আসামে বাঙালি সংখ্যার জোরে (৬৭%) যে ভারসাম্য বজায় ছিল, তা খর্ব হয়। ব্যারাকভ্যালির বাঙালিদের দৃশ্যমাণ দুর্দশার শুরু হয় তখন থেকে। ১৯৪৭ সালে বাঙালি বিভক্ত হয় ধর্মীয় ভিত্তিতে। মুসলমান বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠ অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা পাকিস্তান কাঠামো থেকে বর হয়ে আসলেও পশ্চিম বাংলার মুসলমানের ভারতে থেকে যায়। ১৯৪৭ সালে পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা পশ্চিম বাংলার শাসনের অধিকার পেলেও সর্বভারতে যে কর্তৃত্ব ১৯১১ সাল পর্র্যন্ত ছিল তা হারায়। তখন থেকে হিন্দু বাঙালি বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অধঃপতন শুরু হয় তখন থেকে। ১৯১১ সালে বাঙালির বৃহৎ অংশকে বাংলা প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিহারের পূর্ণিয়া জেলা বিহারের সাথে সিলেট, কাছাড় জেলা এবং গোয়ালপাড়া আসামের সাথে সংযুক্ত করে বাঙালি জনগোষ্ঠকে সংকুচিত করে ফেলে। সকল বাংলাভাষীকে একই প্রদেশ নিয়ে আসলে বাংলা ভাগ বা ভারতে ভাগের রাজনীতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতো বলে আমার ধারণা। গোয়ালপাড়া, কাছাড় জেলা হাইলান্দিসহ করিমগঞ্জ জেলার অধিবাসীদের বর্তমান সংকট মোকবিলা করতে হতো না।

 

১৯১১ সালে বঙ্গভক্সগ বাতিল করার পর প্রথমে বাঙালি হিন্দুরা বিভ্রান্তিতে পড়ে। পরে বাঙালিদের বাঙালিত্ব ছেড়ে হিন্দুত্বে কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা ১৯৪৭ সালে পশ্চিম বঙ্গের শাসনক্ষমতা পেলেও দিল্লির করুণার উপর নিজেদের ভাগ্য ছেড়ে দিতে হয়। পূর্ব বাংলা থেকে আগত হিন্দু বাঙালির অভিবাসিত বিশাল অংশকে আত্মীকরণ করতে গিয়ে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জটিলতায় পড়ে যায়। এখান থেকে এখনও উদ্ধার হয়েছে বলে মনে হয় না। পূর্ব বাংলার মুসলমান ও হিন্দু ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি করে। স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হিসেবে বাঙালি অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। এই গর্বের অংশিদার হওয়ার কথা ছিল গোয়ালপাড়া, শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকিন্ধর হিন্দু মুসলমান উভয়ে। বৃহত্তর আসামের অবাঙালি জনগোষ্ঠী ভারতে সংযুক্ত হতো না তখনকার পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশে) সংযুক্ত হতো, এটা তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা এবং আকাক্সক্ষার উপর নির্ভর করতো। তবু বর্তমান বাংলাদেশ ও আসামসহ এক সাথে থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হিসেবে আজকে জটিলতা গোয়ালপাড়া করিমগঞ্জ হাইলাকন্দিও লোকজনের পড়তে হতো না। তবে এখানে একটু স্মরণ করা উচিত বাংলাভাষা ও বাঙালিত্ব নিয়ে কাছাড় জেলা ও করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দিও অধিবাসীদের যে সচেতনতা ছিল, তা কিন্তু গোয়ালপাড়ার বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ছিল না। (চলবে)

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট