চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিয়াটল টু নিউ ইয়র্ক : উই আর দ্যা সিক্স গাইজ

আতিকুল ইসলাম 

২৭ এপ্রিল, ২০২১ | ২:৪৬ অপরাহ্ণ

কিছু টাকা এবং তার পাসপোর্ট খোয়া গেল। নতুন এসেছি এদেশে, তাই আর কিছু করা গেল না। দিনের সোয়া বারোটায় ভীত মনে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম হ্যারিসবার্গের উদ্দেশ্যে।

যুক্তরাষ্ট্রে একশরও বেশি দূর পাল্লার বাস কোম্পানিগুলোর অন্যতম হচ্ছে গ্রেহাউন্ড (ডালকুত্তা) বাস কোম্পানি। কোম্পানিটি ৩,৮০০ গন্তব্যে সেবা প্রদান করে। গ্রেহাউন্ড ছাড়াও রয়েছে পিটার প্যান, ট্রেইলওয়েস, ইদানিংকালে বোল্ট, মেগা বাস এবং অসংখ্য চীনা বাস কোম্পানির দেখা মেলে। একই রুটে যাত্রী কম হলে এ কোম্পানিগুলো যাত্রীদের এক করে একটি বাসে তুলে দেয়।

হ্যারিসবার্গ পেনসালভানিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী এবং একটি বড় শহর। এখনে আমাদের বাস বদল করতে হবে। গ্রেহাউন্ড বাস থেকে নেমে আমরা আমাদের লাগেজ বুঝে নিলাম। তবে  বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ট্রেইলওয়েসের একটি বাস এসেছে অন্য শহরের থেকে। বাসটি প্রায় ভর্তি। বাসটি ফিলাডেলফিয়া হয়ে নিউইয়র্ক শহরে যাবে। আর আমাদের বাসের আমরা ছ’জন ছাড়াও অল্প কিছু যাত্রী নিউইডর্ক যাবেন।

তাই আমাদের বলা হল আমরা যেন ট্রেইলওয়েসের বাসে উঠে পড়ি। আমরা ট্রেইলওয়েজ বাসে উঠলাম। উঠেই দেখি আমাদের পাঁচ বন্ধু সিট পেয়েছেন কিন্তু আমি পাইনি। আমি দাঁড়িয়ে আছি। এ সময় গ্রেহাউ- কোম্পানির এক কর্মচারী উঠে এলেন বাসটিতে। আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন নেমে যেতে। প্রথমে আমি নামতে রাজি হইনি, বললাম দাঁড়িয়ে হলেও যাব। লোকটি বললো আইন অনুযায়ী কেউ দাঁড়িয়ে যেতে পারবে না। তিনি জোর করে আমাকে নামিয়ে আনলেন।

বললেন, আমার একার জন্য একটা খালি বাস আসবে। কিন্তু একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমি তাকে জানালাম আমার পাঁচ বন্ধু ট্রেইলওয়েসের বাসে বসে আছেন। লোকটি ওদেরও নামিয়ে আনলেন। আমরা বাসের লাগেট কম্পার্টমেন্ট থেকে আমাদের লাগেজ বের করে স্টেশনের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে রইলাম। বাইরে বেশ ঠা-া ছিল, টার্মিনালের ভেতর বেশ আরাম করেই বসে ঝিমুচ্ছিলাম।

প্রায় দুই’ ঘণ্টা পর শুনতে পেলাম পাবলিক এনাউন্সমেন্ট সিস্টেমে ঘোষণা হচ্ছে, ‘সিক্স গাইজ টু নিউ ইয়র্ক, ইওর বাস ইজ রেডি, প্লিজ প্রসিড টু বোর্ডিং গেট ফাইভ।’ গেটে যেতেই কৃষ্ণাঙ্গ ড্রাইভার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর ইউ দা সিক্স গাইজ?’ আমরা সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বললাম, ‘ইয়েস, ইয়েস, উই আর দা সিক্স গাইজ।’

হ্যারিসবার্গ শহর ছেড়ে বাসটি যখন ইন্টারস্টেট ও-৭৮ এ উঠল তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ৫২ সিটের পুরো বাসটিতে আমরা মাত্র ছ’জন যাত্রী। একেক জন চারটি করে সিট দখল করে বসে পড়লাম। ড্রাইভার জানালেন আমরা ফিলাডেলফিয়ায় থামবো না কারণ আমরা ছ’জনই যাচ্ছি নিউইয়র্ক শহরে। ঘুমাবো বলে ড্রাইভারকে অনুরোধ করে সবগুলো কেবিন লাইন নিভিয়ে নিলাম। রাজপথে কোনো বাতি নেই। বাইরে দেখবারও কিছু নেই। শুধুমাত্র বাসের হেডলাইটের আলোয় রাস্তা দেখা যাচ্ছে। অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

নিউইয়র্ক শহরটি (New York City) একটি দ্বীপ শহর। এ দ্বীপটির নাম হচ্ছে ম্যানহেট্যান আইল্যান্ড। শহরটি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের (New York State) ) একটি প্রধান শহর। এটিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র (Financial Capital) বলেও আখ্যায়িত করা হয়। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের এক কোটি সাত লক্ষ জনসংখ্যার আট লক্ষ জনগণই বাস করেন নিউইয়র্ক শহরে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যটি আয়তনে ৫৪,৫৫৬ হাজার বর্গ মাইল অথবা ১,৪১,২৯৯ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনে প্রায় বাংলাদেশের সমান। এটির রাজধানী আলবানী (ইংরেজিতে আলবেনি বলা হয়) যা কিনা নিউইয়র্ক শহর থেকে ২৪৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ম্যানহেট্যান দ্বীপটির পশ্চিমে হাডসন রিভার এবং পূর্বে ইস্ট রিভার। পশ্চিমে একটি ব্রিজ (জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ) এবং দুটো আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল লিংকন এবং হল্যান্ড টানেল দিয়ে নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে দ্বীপটি সংযুক্ত। এ টানেল দুটো দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ২.৪ এবং ২.৬ কিলোমিটাল।

চৌঠা জুলাই ১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে থমাস জেফারসন (Thomas Jefferson) যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দিনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। ২৫ নভেম্বর ১৭৮৩ সালে সর্বশেষ ব্রিটিশ সেনা, নব গঠিত দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন। আঠারো শতাব্দীর শেষভাগে বন্ধুরাষ্ট্র ফরাসি দেশের জনগণ ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ হিসেবে সম্পূর্ণ তামার তৈরি স্বাধীনতা মানবমূর্তি লেডি লিবার্টি (Statue of Liberty) যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে উপহার দেন। মূর্তিটির নকশা করেন গুস্তাভ আইফল, যিনি প্যারিসের আইফেল টাওয়ারেরও নকশা করেন। মূর্তিটির নাম রাখা হয় স্বাধীনতার আলোকিত বিশ্ব (Liberty Enlightening the World)। ৩০৫ ফুট উচ্চতার এ ভাস্কর্যটির বা হাতে রয়েছে একটি ফলক তাতে রোমান অক্ষরে খোদাই করে লিখা JULY IV MDCCLXXVI (জুলাই ৪ ১৭৭৬) আর ডান হাতে একটি মশাল।  মশালের আগুন খাটি সোনায় মোড়ানো। বা পায়ে ভাঙা শিকল আর ডান পা দিয়ে ভাস্কর্যটি যেন দৃঢ় মনে সামনে আগ বাড়াচ্ছে। তামার রং যদিও খয়েরি, তামা এবং অক্সিজেনের প্রতিক্রিয়ায় এই ভাস্কর্যটি গাঢ়ো সবুজ রঙে পরিণত হয়েছে। রঙের এ স্তরটিকে ইংরেজিতে বলা হয় পাটিনা (patina)।  ভাস্কর্যটিকে স্থায়ীভাবে নিউইয়র্ক শহর নদীবন্দরে একটি ছোট দ্বীপে স্থাপন করা হয়। দ্বীপটির নাম রাখা হয় লিবার্টি আইল্যান্ড। বছরে গড়ে ৩৫ লক্ষ পর্যটক ভাস্কর্যটি পরিদর্শন করতে আসেন বিভিন্ন দেশ থেকে। রাতে নিচ থেকে আলো ফেলে ভাস্কর্যটি আলোকিত করা হয়, যা দূর-দূরান্ত থেকেও দর্শনীয়।

চোখে আলো পড়াতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখি হাইওয়ের দু’পাশে অনেক বাতি জ¦লছে। আমরা লোকালয়ে এসে পড়েছি। চোখ মিট মিট করে বাইরের দৃশ্য দেখছি। এ দিকটায় তেমন একটা তুষারপাত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। দু’পাশে অনেক বড় বড় ভবন। মাঝেমধ্যে দু’ একটা কারখানা দেখা যাচ্ছে। মোটা মোটা চিমনি দিয়ে ঘন সাদা ধোয়া বের হচ্ছে।

আমি ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম আমরা নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের নিউ জার্সি টার্নপাইকের (বিশেষ ধরনের হাইওয়েকে টার্নপাইকও বলা হয়) উপর দিয়ে নিউইয়র্ক শহরের দিকে এগুচ্ছি। কিছুদূর যাবার পর বেশ দূর থেকে নিউইয়র্ক শহরের আকাশ ছোয়া ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আলো ঝলমলে টাওয়ারগুলো দেখতে পেলাম। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। তার পরপরই চোখে পড়ল স্বাধীনতার প্রতীক ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’। উত্তেজনায় ঘুম কেটে গেল। সবাইকে জাগিয়ে দিলাম। এসে গেছি আমরা স্বাধীন দেশের স্বপ্নের শহরে। লিংটন টানেল দিয়ে আমাদের বাসটি প্রবেশ করল নিউইয়র্ক শহর। পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে যখন আমাদের বাসটি শেষবারের মত থামল তখন রাত প্রায় এগারোটা, ১৯ জানুয়ারী। (সমাপ্ত)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট