চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিয়াটল টু নিউ ইয়র্ক : উই আর দ্যা সিক্স গাইজ

আতিকুল ইসলাম

১২ এপ্রিল, ২০২১ | ৩:৩২ অপরাহ্ণ

বাস বদল হল। ড্রাইভারকে আমাদের স্যুটকেসগুলো দেখিয়ে দিয়ে আমরা বাসে উঠলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বুট্টি, যা কিনা মন্টানা অঙ্গরাজ্যের একটি বড় শহর। বুট্টি শহরকে বলা হয় The Richest Hill on Earth এ শহরটিতে তামার খনি রয়েছে। আমাদের বাস যখন স্পোকেন শহর ছাড়ে, তখন ঘড়িতে প্রায় ভোর সাড়ে তিনটে হবে। আমরা আবারো ও -৯০ দিয়ে ছুটে চলছি। কিছুদূর যাবার পর একটি আলো ঝলমলে সাইনবোর্ডে দেখলাম লিখা আছে “Welcome to Montana” দেখতে না দেখতেই আমরা সাইজানবোর্ডটিকে পেছনে ফেলে আগিয়ে গেলাম।যুক্তরাষ্ট্রের এ অংশটা খুব পাহাড়ি। কখনও নিচের দিকে যাচ্ছি, কখনও উপরে। হালকা তুষারপাত হচ্ছে। বাসের হেডলাইটের আলোতে দেখি তুষারের টুকরোগুলো বাসে ধাক্কা খেয়ে উড়ে যাচ্ছে। বেশ মজা পাচ্ছিলাম। ধারণা করলাম বাইরের তাপমাত্রা নিশ্চয় শূন্যের অনেক নিচে। এ দেশে আবার তাপমাত্রা মাপবার জন্য ফারেনহাইট ব্যবহার করা হয়। আবারো ক্লান্তি গ্রাস করে নিল শরীর।

যুক্তরাষ্ট্রসহ মায়ানমার (বার্মা) এবং আফ্রিকা মহাদেশের দেশ লাইবেরিয়াতে ইম্পেরিয়াল সিস্টেম এখনো চালু আছে। এ সিস্টেমে ওজন মাপবার জন্য পাউন্ড (ওন), দূরত্বের জন্য ইঞ্চি, ফুট, মাইল, তাপমাত্রার জন্য  ফারেনহাইট এবং তরল পদার্থের জন্য গ্যালন, আউন্স (ড়ু) ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ কারণে লেখাটিতে     বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাইল ব্যবহার করেছি। শুধুমাত্র আরিজোনা স্টেটে ৬৩ মাইল দৈর্ঘ্য ও-১৯ হাইওয়েতে  কিঃমিঃ ফলকের দেখা মেলে। ও-৯০ আরিজোনার তুসান (Tucsan) শহরে শুরু হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মেক্সিকোতে গিয়ে শেষ হয়।    বিজ্ঞানিরা মেট্রিক সিস্টেমে ব্যবহার করে থাকেন এখানে এবং স্কুলগুলোতে মেট্রিক সিস্টেম শেখানো হয়। ধারণা করা হচ্ছে এতবড় দেশটিতে মেট্রিক সিস্টেম চালু করতে কয়েক হাজার কোটি ডলার খরচ হবে, তাই করা হচ্ছে না।

একটু ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে গেলো। আমরা বুট্টি শহরে এসে পৌঁছেছি শনিবার সকালের দিকে। ড্রাইভার জানালেন ঘড়ির কাটা এক ঘণ্টা আগিয়ে দিতে। আমরা প্যাসিফিক টাইম জোন থেকে মাউন্টেন টাইম জোনে প্রবেশ করেছি। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত। নীল আকাশ, খুবই পরিষ্কার। এক আধটু মেঘ দেখা যাচ্ছে। বাস থেকে নামতেই রৌদ্রের আলো যেন চোখ ঝলসে দিলো। এ প্রথম সকালের সূর্য দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রে। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হল।

বিশ্রাম করবার জন্য স্টেশনে এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাদের হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন নিচে যেতে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে গিয়ে দেখি সারি বেধে বাথরুম। জানতাম না যুক্তরাষ্ট্রে বাথরুমকে রেস্টরুম  (Restroom) বলা হয়। আমরা সবাই খুবই ক্ষুধার্ত। ভালো ব্রেকফাস্ট হল কফি, দু’টি করে টোস্ট, পোচ ডিম এবং আলু ভাজা। ব্রেকফাস্ট স্পেশাল, মূল্য জনপ্রতি ৪.৯৯ ডলার। এ দেশে প্রায় সব কিছুর মূল্যেই যেন .৯৯ দিয়ে শেষ হয়। ডিমের কুসুম ভেঙে না দিলে সেটাকে বলা হয় সানি সাইড আপ ( Sunny side up) তা ওয়েট্রেস থেকে শিখে নিলাম।

দিনে দেড়টার দিকে আমাদের বাস আবার ছাড়লো। ব্রেকফাস্টে এতো খেয়েছি যে দুপুরের লাঞ্চ আর হল না। বাসে কেরোরিনা নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সদালোপী স্কুল শিক্ষিকার সাথে পরিচয় হল। তিনি জেনে খুশি হলেন যে আমরা পড়াশোনা করতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলোনা ওনার। দেশটি কোথায় সেটা ওনাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হল। আজকের আমেরিকাতে অবশ্য মোটামুটি সবাই জানেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। আমরা যতই বলছি আমরা ইন্ডিয়ানদের মতই, কিন্তু মুসলিম, ততই তিনি বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এক বন্ধু একটি কাগজে লিখে দিলেন,  “Muslim”। তা দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে উচ্চারণ করলেন “ওহ, মা-আ-জলিম।” বুঝতে বাকি রইল না মার্কিনি কায়দায় ইংরেজি শিখতে ধৈর্য এবং সময় দুটোই প্রয়োজন। তিনি জানালেন ফ্লোরিডা যাচ্ছেন ছুটি কাটাতে। বিমানে ভ্রমণ করলে এতকিছু দেখা হবে না তাই আমাদের মতই বাসে ভ্রমণ করছেন।

মন্টানা অঙ্গরাজ্যেরই আরেকটি বড় শহর বিলিংসে যখন পৌঁছাই তখন সন্ধ্যে সোয়া সাতটা। বিলিংসে রয়েছে বড় শপিং সেন্টার এবং অত্যাধুনিক হাসপাতাল। আশে পাশের স্টেট থেকে এখানে সবাই আসেন শপিং করতে। আধার নেমেছে অনেক আগেই। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। স্টেশনে ঢুকতেই মিস কেরোরিনা আমদের মনোবাসনা পূর্ণ হোক (good luck) বলে বিদায় নিলেন। তিনি অন্য বাস ধরে দক্ষিণে পাড়ি দেবেন। এ স্টেশনে একটি ফাস্ট ফুডের দোকান পেলাম। আমরা সবাই ধারণা করছিলাম সবকিছুতেই বুঝি শুকরের মাংস আছে। আমরা চিকেন ফ্রাই চাই, কিন্তু ক্লার্ককে বোঝাতে পারছি না। বন্ধু শাহিন দু’হাত বগলে দিয়ে রাতা মোরগের মত শব্দ করছে আর দু’হাত ঝাকড়াচ্ছে। দোকানী হেসে আমাদের ৫নং মেনু দেখিয়ে দিলেন। চিকেন বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং একটি সোডা, মূল্য জনপ্রতি ৬.৯৯ ডলার। হালকা পানিও যেমন কোক, পেপসিকে যে সোডা তা জেনে নিলাম। আমরা খাবারের দাম মিটিয়ে দিয়ে টেবিলে বসে রয়েছি। সেই ক্লার্ক এলেন দু’ ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে। টেবিলে খাবার রেখে হেসে বললেন পক পকা-আ-আ পক পক। বোঝা গেল মার্কিনিরা রসাত্মক জাতি।

রাত সাড়ে ন’টায় বাস ছাড়ল মাইলস সিটির উদ্দেশ্য। এবার বাস যাচ্ছে ও-৯৪ এর উপর দিয়ে। ঘোড়া কেনা-বেচার পৃথিবীর সবচাইতে বড় মার্কেট এই শহরটিতে। বাস প্রায় ভর্তি। আমার পাশের সিটে বসে পড়লেন বেশ বয়স্ক এক ভদ্রলোক। আপন মনেই কি বিড়বিড় করছেন বুড়োটি তা আন্দাজ করতে পারছি না। প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমার সাথে কথা না বলেন। ওনার কথা বুঝবো কিনা, বা কি বলবো তাতো জানি না। হঠাৎ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাউডি, হাউ ফার ইউ গোইন?’ কেমন আছেন- এ বাক্যটি এ দেশে অনেক ভাবেই বলা হয়ে থাকে। সবচাইতে প্রচলিত হচ্ছে, ‘হাউ ইউ ডু ইন।’ তারপরেই ‘হাউ আর ইউ’,   ‘হাউডি’ ইদানিংকালে ‘হোয়াটস হ্যাপেনিং’ ইত্যাদি। আমেরিকানরা আবার রহম কে সংক্ষিত করে রহ (ইন) উচ্চারণ করেন, ‘ম’ উচ্চারণ করেন না। তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন কতদূর যাচ্ছি আমি। কাউকে ‘কোথায় যাচ্ছেন’ জিজ্ঞেস করাটা অভদ্রতা, কিন্তু কতদূর যাচ্ছি তা জিজ্ঞেস করা যায়। তাঁর কথা বুঝতে সময় লাগল। বললাম নিউইয়র্ক যাচ্ছি। চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘নিউইয়র্ক সিটি? ন্যাস্টি, ডাস্টি এন্ড ডেনজারাস। আই হ্যাভ নেভার বিন টু নু ইয়র্ক।’ (পরের অংশ দেখুন আগামীকাল)

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট