চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রমূর্তি বিলাইছড়ি নীলাদ্রি রিসোর্ট

অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রমূর্তি বিলাইছড়ি নীলাদ্রি রিসোর্ট

এজাজ ইউসুফী

২৬ অক্টোবর, ২০২০ | ৫:৪২ অপরাহ্ণ

‘ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে/তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে’-ইবনে বতুতা। জাগতিক ব্যস্ততায় দিন কাটে আমাদের। রিস্টওয়াচ থেমে থাকে না। নীল জল কিংবা সবুজ পাহাড় হাতছানি দেয়। অন্যদিকে, করোনা মহামারী আমাদের ঘরবন্দি করেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই মন ছুটলো অজানার সন্ধানে। আগে যেখানে যাওয়া হয় নি।

আজকের ভার্চুয়াল সময়ে বিনোদন স্পটগুলো ঘরে বসেই দেখা যায়- কিন্তু উপভোগ করা অন্যকথা। প্রকৃতির সন্তান তাকে সরাসরি আস্বাদ করতে না পারলে আশ মেটে না। ঠিক হলো এবারের গন্তব্য বিলাইছড়ি নীলাদ্রি রিসোর্ট-এ রাত্রিযাপন এবং ঝর্নায় অবগাহন। কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই হ্রদের জলরাশির সৌন্দর্য এবং গাঢ় সবুজাভ পাহাড়ের মোহনীয় রূপ দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবো কাক্সিক্ষত স্থানে। আমরা কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে গত বুধবার সকালে রওনা দিয়ে দুপুরে পৌঁছে গেলাম কাপ্তাই। সেখান থেকে রিজার্ভ বোটে করে প্রায় দু’ঘণ্টায় বিলাইছড়ি।

মনে পড়ে গেলো কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পাহাড় চূড়ায়’ কবিতার কিছু পঙ্ক্তি:
‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।/কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।/যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।’

আমরা মানে আমি ও প্রকৌশলী প্রকাশ ঘোষ, তার শিল্পী-স্ত্রী করবী দাশ এবং টুই-বাবুই দুই ছানা তাদের। দুপুরের খাবার খেয়ে নীলাদ্রি রিসোর্ট রুমে গিয়ে পৌঁছাতে সবাই ভিজে জবজবে। বৃষ্টির অঝোর কান্না যেন থামছেই না। পেছনের কাঠের বারান্দায় বসে ধুমোল পাহাড় আর মেঘের খেলা দেখেই কাটলো। আর দেখা হলো একটি তারের উপর প্রচ- বৃষ্টিতে ভিজে দুই দোয়েল পাখির মান-অভিমানের খেলা।

সেই কবেকার লোককথা। নৃ-গোষ্ঠীর একদল কাঠুরিয়া গহীন জঙ্গলে প্রবেশ করেছে কাঠ সংগ্রহ করতে। হঠাৎ যমদূতের মতো হাজির হলো বিশালদেহী এক বনবিড়াল। বিড়ালটি কাঠুরিয়াদের আক্রমণ করে বসে। কিন্তু পাহাড়ী লোকদের হাতে চকচকে দায়ের কোপে মারা পড়ে বিড়ালটি। তারা বিড়ালটি মেরে পাড়ায় নিয়ে গেলে সকলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। এতো বড় বিড়াল তারা জীবনেও দেখে নি। আদিবাসীরা এ উপলক্ষে পানীয়সহযোগে বিরাট ভোজের আয়োজন করে। এরপরই তার নামকরণ হয় ‘বিলাইছড়ি’। চামকা উপজাতীয় অর্থে ‘বিলাই’ হচ্ছে বিড়াল। আর ‘ছড়ি’ হচ্ছে, ঝর্না, একত্রে বিলাইছড়ি।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং দু’পাশের আকাশছোঁয়া গভীর সবুজ পাহাড়ের গা গেঁষে একটি ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ বিলাইছড়ি। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। অন্যদিকে, বিশাল কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের জলরাশি। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রাইখ্যং নদীর প্রবাহ। এর পাশেই আছে দুমলং পর্বতশৃঙ্গ। বেসরকারি মতে এটাই দেশের দ্বিতীতয় বৃহত্তম পর্বতশৃঙ্গ। বিলাইছড়িতে ১৬টি মসজিদ, ২টি মন্দির, ৪২টি বৌদ্ধবিহার এবং ৪টি গির্জা আছে। এর অধিবাসীরা হচ্ছে, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা, মারমা, পাংখোয়া, বম, হিন্দু এবং মুসলিম।

বিলাইছড়ি উপজেলা একসময় দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখানে উপজাতীয় বিদ্রোহ দেখা দিতো অহরহ। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানের পরাজয় ঘটলে তাদের সমর্থক প্রায় দু’হাজার পাহাড়ী বিদ্রোহী মিজোরামে আশ্রয় নেয়। পাহাড়ি অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এদের একত্রিত করে এক সময় শান্তিবাহিনীর গোড়াপত্তন করেছিলেন। এক সময়ে উত্তপ্ত বিলাইছড়ি আজ পর্যটন পিয়াসীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। বিশেষ করে ঝর্নার বাহুল্যের কারণে এটি দিন দিন জনপ্রিয় পর্যটন-স্পট হয়ে উঠেছে।
এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বর্ণময় এবং উচ্চতাসম্পন্ন ঝর্না হচ্ছে ধূমপানি ঝর্না। বিলাইছড়ি থেকে বড় বোটে করে ঝর্নার কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। সেখানে আরও দুই থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা ঝিরিপথে হেঁটে। তবে, ঝর্নাগুলো বিলাইছড়ির কাছাকাছি হলেও এর যাতায়াত খুব দুর্গম। পিচ্ছিল পথ, জোঁকের আক্রমণ এবং পাথরের তীক্ষ্ম চূড়া পেরিয়ে যাওয়াটা একটু কঠিন বৈকি। মূলত চার ইউনিয়ন নিয়েই মূল বিলাইছড়ি। এগুলো হচ্ছে, বিলাইছড়ি, ব্যাংরাছড়ি, ফরোয়া এবং বড়তলি ইউনিয়ন।

মনীষী জন স্টেইনব্যাক বলেছেন- ‘মানুষ ভ্রমণকে গ্রহণ করে না, ভ্রমণই সঠিক মানুষ খুঁজে নেয়।’ আমরা সঠিক মানুষ না হলে ওয়েদার ফোরকাস্ট না দেখেই এমন এক দুর্গম পার্বত্য এলাকায় ছুটে গেলাম! মনোমুগ্ধকর তিনটি আলাদা কটেজ আর একটি রিসেপশন নিয়ে নীলাদ্রি রিসোর্ট। এর বড় আকর্ষণ ঝুলন্ত ব্রিজ। আরও আছে ওয়াচ টাওয়ার, সুশোভিত ঘাসে ঢাকা চত্বর, কাঠের উন্মুক্ত মঞ্চ, দোলনা, খাবার কেন্টিন ইত্যাদি।

খাবারেও যেন সেই পাহাড়ী ঝালের স্বাদ। কিন্তু রিসোর্টে সুবিধা তেমন একটা নেই। টাওয়েল, টয়লেট্রিজ, টেবিল কিংবা ভেতরে বসার জন্য কাঠের সোফাসেট না থাকাটা কষ্ট দিয়েছে। ইউএনও পারভেজ চৌধুরীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, প্রথম পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড ঝুলন্ত ব্রিজটি করে দেয়। পরে তাঁর উৎসাহে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় এই নয়নাভিরাম রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়। অন্যদিকে, জেলা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য রেমলিয়ানা পাংখোয়া একটি ভিআইপি কটেজ করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ইউএনও আরো জানান, শুক্র ও শনিবার বন্ধের দিনে কটেজগুলো আগে থেকেই করা হয়ে যায়। তিনি জানান, এটি মাত্র শুরু হলো। ধীরে-সুস্থে এর সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো হবে।

 

 

 

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট