আমি কোনো একটি দেশ ভ্রমণে গেলে, সেদেশের কৃষ্টি-কালচার, সমাজ ,সংস্কৃতি, ইতিহাস জানার জন্য সে দেশের কোন স্মৃতি বিজড়িত স্থান, মিউজিয়াম অথবা বিশ্ব ঐতিহ্য গুলো দেখাকে প্রথম প্রাইওরিটি তে রাখি। ইতালির নাপোলি তে এসে তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
পাহাড় ও সমুদ্র বেষ্টিত ইতালির দক্ষিণ দিকে নেপলস অবস্থিত। এখানে আছে মাউন্ট ভিসুভিয়াস, ভূগোলে পড়েছিলাম এটি একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। আছে হাজার বছরের পুরাতন খ্রিষ্টপূর্বে গঠিত পম্পেই নগরী, এই নগরীর সবকিছুই আগ্নেয়গিরির লাভায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তার চিহ্ন এখনো সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য উদাহরণ হয়ে আছে। এখানে আছে নেপলস আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম, জানতে পারবেন তাদের পূর্বের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। Naples Harbour এ অবস্থিত Castel dell’Ovo নামে দুর্গ টিতে পানির ঢেউয়ের উপচে পড়ার দৃশ্য আপনাকে কিছু সময়ের জন্য সবকিছু ভুলিয়ে দিবে। ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর অন্যতম সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস দেখতে পাবেন, যা সত্যিই মনমুগ্ধকর।
ইতালির নেপলস কে ইতালিয়ানরা নাপোলি নামে ডাকে। এই নাপোলি কে বলা হয় পিৎজার জন্মভূমি । ইউরোপিয়ানরা পিৎজা লাঞ্চ অথবা ডিনার হিসাবে খায়। বাংলাদেশে পিৎজাকে ফাস্টফুড হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। নেপোলিটান পিৎজা এই দেশের সবচেয়ে সেরা পিৎজা। টমেটো,পনির, পেঁয়াজ, ময়দা দিয়ে তৈরি এই খাবারটি আমাদের দেশে প্রথম প্রথম যখন চালু হয়, শুধুমাত্র একটি শ্রেণি ফাস্ট ফুড হিসাবে খুব বেশি ভাব নিয়ে খেত। বর্তমানে আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে সবাই পিৎজা চিনে এবং কম বেশি খায়। যাহোক নাপোলি তে এসে পিৎজা খাওয়াটা আমার জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি উঠেছি আমার বোনের বাসায়। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তাদের এই দেশে আসা। তারা এই শহরে বেশ কয়েক বছর ধরেই আছে। আমার ভাগ্নি সবে ইতালিয়ান স্কুলে ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ শিখছে, আর তার মা-বাবাকে অবাক করে দিচ্ছে। আমার কাছে মনে হল, আমার বোন এত বেশি ইতালিয়ান জানেনা, যতটুকু আমার ভাগ্নি জানে। তাদের বাসায় বাংলা ভাষার মাঝে এলোমেলো কিছু শব্দ শুনে আমার কাছে একটু অপরিচিত লাগছিল। দু’একদিন পরে বুঝলাম এ শব্দগুলো আসলেই ইতালিয়ান শব্দ অর্থাৎ লাতিন শব্দ। যাহোক আধ লাতিন শব্দ দিয়ে তার ছোট ছোট বাক্য রচনা আমার কাছে ভালই লাগছিল। আমিও তার কাছ থেকে দু-একটি লাতিন শব্দ শিখতে থাকলাম।
আমার ছোট্ট ভাগ্নিকে নিয়ে, একদিন সকাল বেলায় বের হলাম তাদের শহর দেখতে হেঁটে হেঁটে। নাপোলি স্টেডিয়ামের পাশে তাদের বাসা। বাসার সামনেই স্টেডিয়াম হওয়াতে চিৎকার-চেঁচামেচি স্লোগান প্রায় সময় লেগেই থাকে। নাপোলি ক্লাব এর ফুটবল ম্যাচ আছে আজকে। পুরা শহরে হইচই পড়ে আছে। এই শহরবাসীর আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। বলে রাখি, এটাই সেই ক্লাব, যে ক্লাবে দিয়াগো ম্যারাডোনা, একজন ম্যারাডোনা হয়ে বিশ্বের সেরা ফুটবলার হিসেবে প্রথম সারির কাতারে অবস্থান করে নিয়েছেন।
বিশাল বড় স্টেডিয়াম। লোকজন আসা শুরু করেছে আগেভাগে। তাদের একই কালারের জামা, টুপি আর হাতে রং বেরঙের ফেস্টুন। দেরিতে আসলে স্টেডিয়ামে বসার জায়গা পাওয়া যায় না আর গাড়ি পার্কিং করতেও অনেক সমস্যা হয়, তাই আগেভাগেই আসা। স্টেডিয়াম ক্রস করে কতদূর যাওয়ার পরে দেখলাম, খেলোয়ার ও কলাকুশলীরা বাস থেকে নামছে। তাদের দেখে ভক্তরা সুরে সুরে লাতিন ভাষায় গান করছে। অনেক ভালো লাগতেছে এইসব ফুটবল পাগলদের একসাথে দেখতে পেয়ে।
রাস্তার ধারে হাঁটতে হাঁটতে একটি গির্জা চোখে পড়লো, কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মানুষকে দেখলাম গির্জার উঠানে আগত কবুতর গুলোকে খাবার দিচ্ছে। কিছু খাবার আমরাও দিলাম নির্ভয় কবুতরগুলো কাছে আসছে দেখে আমার ভাগ্নির চোখ মুখ আনন্দে ফুটে উঠল। গির্জার একটু পাশেই একটা বাস স্টপেজ চোখে পড়ল। পঞ্চাশোর্ধ দুজন লোক সাথে তাদের দুজন বাচ্চা, বাসস্টপে রাখা ম্যাগাজিন আর পত্রিকা পড়ছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। তাদের চোখ পড়াতেই সীমাবদ্ধ। উন্নত দেশগুলো উন্নত হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। আমার কাছে অন্যতম একটি কারণ মনে হয়েছে তাদের পড়ার অভ্যাস। আপনি বাসে, ট্রেনে, প্লেনে যেখানেই যান না কেন, তাদেরকে পারস্পারিক কথা বলতে খুব কমই দেখবেন। দেখবেন – হাতে বই নিয়ে অথবা পত্রিকা নিয়ে অথবা ল্যাপটপ নিয়ে চুপচাপ বসে বসে কাজ করছে। আর পাবলিক বাসে, ট্রেনে উঠলে আমরা করি চেঁচামেচি আর অন্য জনকে করি বিরক্ত।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। বিজ্ঞাপনটির সারাংশ হল এই, একটি বোবা মেয়ে বাসে উঠেছিল। সেখানে এসে বাসের কন্টাকটার থেকে শুরু করে যাত্রীদের কাছ থেকে মাতৃভাষা বাংলার অপব্যবহার দেখতে পেয়ে খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিল। বাসের কন্টাকটার যখন ভাড়া চাইতে গেলেন। সেই মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে কলম দিয়ে কাগজে লিখে বুঝিয়ে দিল, যে ভাষায় তোমরা কথা বলো সে মাতৃভাষাকে তোমরা নিচু করে দিয়েছ। তাই কথা না বলে বোবা হওয়ায় তার জন্য উত্তম। যাহোক ইউরোপের দেশগুলোর বাস এবং ট্রেনের উঠলেই বুঝতে পারবেন ভদ্রতা, নম্রতা কাকে বলে।
আর একটু দূরে যাওয়ার পর আমার ভাগ্নি আমাকে তার স্কুলটি দেখালো। রবিবার স্কুল বন্ধ থাকে। তবুও স্কুলের গেটে দু’তিন জন তার বন্ধু-বান্ধবকে দেখতে পেলাম, ছোট্ট একটি কৌশল বিনিময় করল ছোট ছোট বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে। লাতিন ভাষায় কি কি জানি বলল আমি কিছুই বুঝলাম না। তবে আমি যা বুঝলাম সেটা হল ভদ্রতা সুলভ তারা নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করেছে। সকালবেলার অভিবাদন ‘গুড মর্নিং’ বলেছে। এই ছোট ছোট বাচ্চারা সকালবেলা হাঁটতে বের হয়েছে তাদের পিতা-মাতার সাথে, সাথে তাদের পোষা কুকুরটিও নিয়ে এসেছে তারা। মজার ব্যাপার হলো কুকুরটিকেও তারা শীতের পোশাক পরিয়ে দিয়েছে। তারা জানে, তাদের পোষা প্রাণীদেরও শীত কাবু করে। তাই তাদের পোষা প্রাণীগুলোকে তারা যত্ন করে তাদের মত করে ভালোবাসার চাদরে রেখেছে। এই দৃশ্যগুলো আপনি শুধুমাত্র শীতের দেশ ইউরোপেই দেখতে পাবেন।
আর একটু সামনে এগিয়ে যেতে দেখলাম, বিশাল একটি মাঠ, এটি আসলে একটি পার্কের মতই। এ পার্কে অনেক জনকে মর্নিং ওয়াক করতে দেখলাম। আবারও একই দৃশ্য সাথে তাদের পোষা প্রাণীটি কেউ কেউ সাথে করে নিয়ে এসেছে। ইউরোপিয়ানদের দুটি বিষয় আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে, তাদের স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস আর পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রা।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, আর খিদাও লাগছিল ভালোই। আমার ভাইয়া রাস্তার ওপারে গিয়ে আমাদের জন্য একটি বড় পিৎজা কিনে নিয়ে আসলেন। পার্কে বসে কয়েক টুকরা পিৎজা খেয়ে পেট ভরে গেল। নেপোলিটান পিৎজা দারুন মজাদার একটি খাবার। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে এক অন্যরকম তৃপ্তি অনুভব করবেন। এই তৃপ্তির স্বাদ মনে করলেও তৃপ্তি পাবেন। এখন আমার নেপোলিটান পিৎজা খেতে ইচ্ছা করছে আবার।
লেখক পরিচিতি :
উপ-সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ