চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ব্যাংককের ভাসমান বাজারে কিছু স্বপ্নময় অভিজ্ঞতা

ড. তৈয়ব চৌধুরী

১৬ জুলাই, ২০২০ | ৪:০৫ অপরাহ্ণ

রোটারী ইন্সটিটিউটের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ম্যানিলা যাচ্ছিলাম। থাই এয়ারওয়েজের টিকেট নেয়াতে ব্যাংকক হয়ে ম্যানিলা। ব্যাংককে যদিও বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে এবারও কয়েকদিন থেকে যাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। ভিসা লাগিয়ে নিলাম, যাত্রাসঙ্গী হিসাবে প্রায়ই একজন নির্ধারিত থাকে, খালাতো ভাই রোটারিয়ান জসিম উদ্দিন চৌধুরী। তবে এবার ব্যাংককে যাত্রাবিরতির উদ্দেশ্যটা একটু অন্যরকম। ব্যাংককের বা থাইল্যান্ডের আলো ঝলমলে চাকচিক্য থেকে দূরে গিয়ে গ্রামীণ জনপদ বা মফস্বলকে দেখা। তিন রাতের যাত্রাবিরতি ছিল। কোথায় কোথায় যাওয়া যায় তা ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করছিলাম। সাফারী পার্কে আগেও দুইবার গিয়েছি, তাই সেটা আকর্ষণ করেনি। অনেকের মুখে শুনেছি আর ইন্টারনেটে ও ব্যাংককের ভাসমান মার্কেটটির ছবি আর বর্ণনা দেখে আকৃষ্ট হলাম। কীভাবে যাওয়া যায়, কত দূরে, তা ঘাটাঘাটি করে পরিকল্পনা করছিলাম। এরমধ্যে ব্যাংককে পৌঁছে প্রথমদিনই একটা ধাক্কা খেয়েছি। এয়ারপোর্টে নেমে হোটেলে যাওয়ার জন্য টেক্সি স্টেশন থেকে টেক্সি নিলাম। মিটারই যাওয়ার কথা কিন্তু টেক্সিতে উঠার পর খেয়াল করলাম ড্রাইভার মিটার চালু করেনি। মিটারে একটু হাত দিয়ে কি জানি করল। মনে মনে ভাবছিলাম আজ কপালে দুঃখই আছে। অনেকদূর ঘুরিয়ে অনেক টাকা দাবী করবে। টেক্সি যখন হোটেলে পৌঁছল নামার পর ড্রাইভার আটশত বাথ দাবী করল।

আমরা যখন জিজ্ঞেস করলাম মিটার চালাওনি কেন? তখন একটা ভাড়ার চার্ট ধরিয়ে দিল। এয়ারপোর্ট থেকে আটশত বাথবড় টেক্সি ক্যাবের ভাড়া। একটু অভিযোগ করাতে একশত বাথ কম নিল। ধাক্কা খেয়ে একটু শিক্ষা হয়ে গেল। এরপর থেকে যে কয়দিনই টেক্সি নিলাম, যা ভাড়া বলে তার অর্ধেক নয়তো মিটারে যাওয়া। তবে অধিকাংশ টেক্সি মিটারেই চলে। খুব কমসংখ্যক একটু টাউট টাইপের আছে। বেশীর ভাগ হোটেলেই টেক্সি ক্যাবের লোকজন থাকে। আমাদের হোটেলেও ছিল। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানসমূহে যাওয়ার নির্ধারিত ভাড়া আছে। অবশ্য দরাদরিও করা যায়। ব্যাংককে আরও একটি মজার ব্যাপার আছে। অনেক কম ভাড়ায় টেক্সিতে চড়া যায়। আপনার নির্ধারিত স্থান ব্যতীত টেক্সি ড্রাইভার আপনাকে আরও দু’একটা স্থানে (কেনা-কাটার জন্য দোকান বলা যায় টুরিস্ট শপ, কাপড় আর হেন্ডিক্রাফটস্) দাঁড় করালে আপনার ভাড়া একদম কমে যায়। একেবারে বিনা পয়সার ভ্রমণ। আপনাকে কেনা-কাটা করতে হবে কথা নাই। রহস্যটা হলো ওরা যেখানে দাঁড় করাবে ওখান থেকে বিনে পয়সায় নির্ধারিত পরিমাণ ফুয়েলের টোকেন পায়। এ অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছিল, এবারেও বাদ যায় নি।

যা হোক প্রথম দুইদিন শহরের আশেপাশে ঘুরে তৃতীয় দিন ভাসমান মার্কেটে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললাম। হোটেল থেকেই টেক্সি ঠিক করলাম মাত্র তিনশত বাথ আসা যাওয়া। দুপুরের খাবার সেরে টেক্সিতে উঠে বসলাম। টেক্সিক্যাব তো নয়, বিশাল এক ভ্যান। বড় ক্যাবগুলোর একটি। ভেবেছি আধাঘণ্টা বা এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছবে। টেক্সি চলছেতো চলছে। ব্যাংকক শহর ছাড়িয়ে হাইওয়ে ধরে আরো বেশ কয়েকটি ছোট ছোট শহর আর গ্রামীণ রাস্তায় প্রায় তিনঘণ্টার কাছাকাছি ড্রাইভের পর একটা পার্কিং লটে এসে থামালো। আমরা দু’জনে ফিসফিস করছিলাম আর ভাবছিলাম তিনশত বাথতো এতটা লম্বা পথের আসা যাওয়া হতে পারে না। আমাদের নামিয়ে দিয়ে তিনশত বাথ দাবী করবে। এদিকে প্রায় সন্ধ্যেও হয়ে গেছে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেলে ব্যাংকক ফিরার গাড়ীও বা আদৌ পাবো কি-না, টেনশন কাজ করছিল।

যে পার্কিং স্পটে ড্রাইভার গাড়ী দাঁড় করালো ওখানে দু’একটা কফিশপ, সুভ্যিনির শপ আর একটা বোটে উঠার ঘাট। ঘাটে বেশ কয়েকটা ইঞ্জিনবোট বাঁধা। আমাদেরকে নামিয়ে বললো এই ভাসমান মার্কেট। আমরা একটু হতাশ হয়েই গেলাম। পরে যারা বোটে ট্যুরিস্ট তোলার জন্য বসে আছে তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম ভাসমান মার্কেটের কথা।

তারা কিছু ছবি দেখালো আর ভাসমান মার্কেটে যাওয়ার প্যাকেজগুলো বর্ণনা করলো। হাতীর পিঠে চড়া, কুমিরকে খাওয়ানোসহ প্যাকেজ। আর শুধু ভাসমান মার্কেট ঘুরে আসার ঘণ্টাব্যাপী প্যাকেজ। ঘণ্টা হিসেবে প্যাকেজের মূল্য, সবগুলো প্রায়ই ঘণ্টায় তিনহাজার বার্থের উপরে। আমরা কি করবো বুঝতে পারছি না। এত টাকা খরচ করে আসলে কিই বা দেখবো একটু খটকাও লাগছে। আবার এতদূর এসে মনের ইচ্ছাটা মিটাতে না পারলেও খারাপ লাগবে। জসিম ভাই বললো, বাদ দাও এসব দেখার দরকার নেই, চল ফিরে যাই। আমি বললাম অন্তত একটু কফি হলেও চুমুক দিয়ে যাই। কফি পান শেষ করে কয়েকটা ছবি তুললাম আর ড্রাইভারকে বললাম চলো ফিরে যাই। ড্রাইভার কেমন জানি রেগেমেগে গাড়ীতে উঠতে বললো। ছবিও তুলতে দিচ্ছে না।
আমরাও মন খারাপ করে ব্যাংকক ফিরে আসার জন্য গাড়ীতে উঠলাম। ড্রাইভার গাড়ীতে উঠে কাকে জানি ফোন করলো। তারপর ২/৩ মিনিট পর গাড়ীটা আরেকটা পার্কিং লটে গিয়ে দাঁড় করালো। এবার বুঝলাম, এখানে বোটে উঠার অনেকগুলো ঘাট আছে। ড্রাইভার আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলো কত টাকা হলে আমরা বোটে চড়বো। আমরাও দিল্লীর লাড্ডুর মত, খেলেও পস্তাবো, না খেলেও পস্তাবো। এ অবস্থায় বললাম এক ঘণ্টায় এক হাজার বার্থ। সে দেড় হাজার বার্থ চাইছিল। পরে এক হাজার বাথেই কাজ হলো। প্রায় ৭/৮ ফিট লম্বা সরু একটি ইঞ্জিন বোর্ট। ৩/৪টি আসন আছে। এক আসনে একজন বসার ব্যবস্থা। সন্ধ্যেও হয়ে গেল। একঘণ্টা ঘুরে আসতেই প্রায় সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা বেজে যাবে। বিকেল পাঁচটার পরে বোটের যাত্রা শুরু বন্ধ হয়ে যায়। আমরা ছাড়া তেমন আর কোন ট্যুরিস্ট নেই। বোটে উঠে দু’জন দুটি আসনে বসলাম। আমাদের দিল্লীর লাড্ডুর যাত্রা শুরু হল। শুরুতেই একটি বড় নালার মত খাল। ৩/৪ মিনিট চলার পর খালটা আরেকটা বড় খালে গিয়ে পড়লো। ১৫/১৬ বছরের তরুণ বোট চালক মনের আনন্দে বোট চালাতে লাগলো। আমরাও ধীরে ধীরে স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতে থাকলাম।

যেটাকে খাল বলেছিলাম, ওটা আসলে ভাসমান মার্কেটের জন্য তৈরী। প্রাকৃতিক না, খালের দু’পাশেই ড্রেনের মত কংক্রিটের দেয়াল দেয়া। সারি সারি নারিকেল আর সুপারী বাগানের মধ্যে দিয়ে ভাসমান মার্কেটের খাল। আর খালের দু’পাশে সারি সারি দোকান। পুরো খাল জুড়েই যে দোকান শুধু তা নয়। এক জায়গায় হতো এক পাশে ২/৩টা অন্যপাশে নেই। আবার কোন জায়গায় দু’পাশেই ৭/৮টা করে দোকান। আমাদের বোট দেখেই দু’পাশ থেকে দোকানীদের হাঁক ডাক। দোকানীদের অধিকাংশ থাই রমনী। দোকানে পণ্যের মধ্যে কিছু খাবারের আইটেম, ড্রিকংস্, বিয়ার এসবতো আছে। আর অধিকাংশই থাই হেন্ডিক্রাফটস্, যা সাধারণত ইউরোপ আমেরিকার টুরিস্টদের আকৃষ্ট করে। কেনা-কাটা সব বোটে বসেই। মাঝে মাঝে ২/১টা রেস্টুরেন্টও চোখে পড়েছে। প্রায় আধাঘণ্টা চলার পর আমরা একটা বড় খালেই এসে পড়লাম। যেখানে দু’পাশে দোকানপাটও একটু বেশী। মনে হলো এটাই আসল ভাসমান মার্কেট। কারণ ওখানে বেশ কয়েকটি দোকান বোটের মধ্যে, প্রায় ষাটোর্ধ এক থাই মহিলার পীড়াপীড়িতে তাঁর বোটের পাশে গিয়ে আমাদের বোট দাঁড়ালো। আমি আর জসিম ভাইকে নানারকম জিনিস দেখাচ্ছিল। আর অনুরোধ করছিল কিছু কেনার জন্য। আমরা শেষমেষ কিছু থাই লিচু আর স্টিকি ম্যাংগো বাইস (বিনি চালের ভাত, কয়েক টুকরো আম আর একটা পলিব্যাগে একটু দুধও, এই হচ্ছে স্টিকি ম্যাংগো বাইস), দাম কিন্তু ব্যাংকক শহরের চেয়ে একটু কমই মনে হলো। এসব কিনে বোট চলা শুরু করলো।

এবার মনে হলো ফেরার পালা। আস্তে আস্তে আবার চেনা পথে ঘাটে ফেরা। এরমধ্যে দু’জন মিলে বোটে বসেই একশত লিচু শেষ করে ফেললাম। ভাসমান মার্কেটের স্বপ্নের সেই অভিজ্ঞতা শেষ করে বোটের ড্রাইভার আর ঘাটের লোকজনকে ধন্যবাদ দিয়ে চোখেমুখে অনেক তৃপ্তি নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম। গাড়ীর ড্রাইভারও একটু খুশীই মনে হল। আমার বুঝতে বাকী রইলো না আমাদের বোটের ট্রিপ থেকে সেও একটা কমিশন পাবে। গাড়ী প্রায় আবার আড়াই ঘণ্টা ফিরতি পথে ব্যাংকক শহরের আলোক ঝলমলে চাকচিক্যের সান্নিধ্যে আসতে ড্রাইভার অনুরোধ করলো আমাদেরকে একটা শপে নিবে কিনা। আমরা তিনশত বাথে এত লম্বা জার্নি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে রাজী হলাম শপে যাওয়ার জন্য। সে আমাদেরকে যে শপে নিয়ে গেল, আগের দিন সেই দোকান থেকেই জসিম ভাই একটা স্যুটের কাপড় কিনেছিল। দোকানদার যদি একই টুরিস্টের জন্য বার বার ফুয়েলের কুপন না দেয় তার জন্য আমি পরিচয়ও গোপন করেছিলাম। দোকানের বিক্রয়কর্মী যদিও আমাদেরকে ঠিকই চিনতে পেরেছিল, আমরা কিছু না কিনে আবার গাড়ীতে উঠে সোজা হোটেলে গিয়ে নামলাম। গাড়ীর ড্রাইভার খুব বেশী খুশী না হলেও আমরা অনেক আনন্দের রেশ নিয়ে আমাদের ভাসমান মার্কেটের ভ্রমণ শেষ করলাম।

রোটারিয়ান ড. তৈয়ব চৌধুরী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট