চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পর্ব-১৪ঃ শিক্ষা বিভাগের কেন্দ্রীয় অফিস পরিদর্শন

মো. ফারুক ইসলাম

২৬ জুন, ২০২০ | ১:১২ অপরাহ্ণ

ইউপি হোটেলে ছবি তোলার পর্ব শেষে সাড়ে সাতটায় আমরা নির্ধারিত গাড়িতে উঠলাম। এবার আমাদের গন্তব্য ফিলিপাইনের শিক্ষা বিভাগের কেন্দ্রীয় অফিস পরিদর্শন। সকাল থেকেই আমাদের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মিস্টার জুন এসে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। গাড়ি চলতে লাগলো গন্তব্যের দিকে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। পুরো ট্যুরে বৃষ্টিই ছিলো আমাদের একমাত্র সঙ্গী। তবে বৃষ্টির দিনে ভ্রমণটা খারাপ হচ্ছিল না। গরমে হাঁপিয়ে উঠার চেয়ে বৃষ্টিতে বেড়ানো অনেক মজার। কারণ শীতল বাতাস আর হালকা ঠাণ্ডা পরিবেশটাকে নতুন রূপ দিয়েছিল। গাড়ি চলতে চলতে পথিমধ্যে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিল। সবাই ফ্রেশ হয়ে যার যার মতো হালকা কিছু খেয়ে নিলেন। এরপর আবার গন্তব্যের দিকে ছুটছিল গাড়ি। গাড়িতে যেতে যেতে সবাই আড্ডা, গানে মেতে উঠেছেন। আমাদের রাজশাহী জেলার শহীদুল ভাইয়ের ইয়া ইয়া, ওপেন টু অল ডায়ালগগুলো শুনে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। যেখানেই গেছি শহীদুল ভাইয়ের এই দুটো প্রিয় ডায়লগ সবার মুখে মুখে। পুরো ট্যুর জুড়ে শহীদুল ভাই ছিলেন আমাদের বিনোদনের মাধ্যম। যেখানে যাই পুরো গ্রুপকে তিনি মাতিয়ে রাখতেন আনন্দে। শহীদুল ভাইয়ের সাথে ছিলেন কুঁড়িগ্রাম জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বাবুল করিম ভাই। ওনারা দুজনেই ছিলেন রুমমেট। কিন্তু মাঝে মাঝে দুজনের ঝগড়া দেখলে মনে হতো এই বুঝি একজন আরেকজনকে মেরে দিলো। কিন্তু না, মান-অভিমান যাই হোক ওনারা ছিলেন মিতা। গভীর টান একজনের প্রতি আরেকজনের। আমাদের গ্রুপে শিল্পী আর কবির কোন অভাব ছিলো না। নাটোরের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা যুথিকা সান্যাল দিদির গানের গলা দারুণ। লালমনিরহাটের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা আলেয়া ফেরদৌসী আপা কবিতা লিখেন আর অসাধারণ আবৃত্তি করেন। খুলনার নীলুপা ইয়াছমিন আপা তার এলাকার শাপলার বিল দেখতে যেতে সবাইকে প্রতিদিনই আমন্ত্রণ জানাতেন। আমাদের খাগড়াছড়ির সুবর্ণা দিদির পাহাড়ি গান আর কথায় সবাই আনন্দে হেসে উঠতেন। কক্সবাজারের পেকুয়ার নাছির উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গ অনেক মজার ছিলো। লক্ষ্মীপুরের বেলায়েত হোসেন ভাইয়ের স্নেহ ভরা ডাক ভুলতে পারি না। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ। বান্দরবানের সাবিনা ইয়াছমিন আপা, কক্সবাজারের শাহানাজ আপা প্রথম দিনেই সাথে ছিলেন। একসাথে অনেক ছবি তুলেছি মার্কেটে। কারো মধ্যে কোন জড়তা ছিলো না। গাইবান্ধার ইফতিয়া বানু আপা এবং রাজশাহীর কাজী আরা পারভীন আপা ছিলেন একটু রিজার্ভ টাইপের। প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না। তবে আনন্দ ভাগাভাগিতে দারুণ অংশ নিতেন। খুলনার আনিস ভাই, বাগেরহাটের কমল কৃষ্ণ বৈদ্য, নাটোরের কমল কুমার সরকার, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবদুর রকিব ভাইদের স্নেহ ভালোবাসার তুলনা হয় না। রাঙামাটির সাবেকুন নাহার আপার কথা বিশেষভাবে না বললেই হয় না, কারণ আমাদের গ্রুপে কোলের বাচ্চা রেখে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ফিলিপাইন ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বাচ্চার চিন্তায় অস্থির থাকলেও আনন্দের কমতি ছিলো না। সবার সাথে অল্পদিনে মিশে গেছেন পরিবারের সদস্যদের মতো। বান্দরবানের সুইচিং মারমা, বাগেরহাটের রুনা লায়লা আপারা ছিলেন অসাধারণ। প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব সত্যি মুগ্ধ করেছে আমাকে। আরেকজনের কথা না বললেই নয়, কারণ পুরো ভ্রমণ জুড়ে যিনি আমাকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করে গেছেন, তিনি হলেন কুঁড়িগ্রামের চৌধুরী শারমিন শামস মনি আপা। নিজের ভাইয়ের মতো করে সারাক্ষণ পাশে পাশে রেখেছিলেন। কোন কারণে মন খারাপ থাকলে বকা দিতেন। ছবি তুলতে গেলে আমাকে জ্বালাই মারতেন! কারণ একসাথে কয়েকটা ছবি না উঠালে আপার মন ভরতো না। আর যেখানেই যেতেন মোবাইলের নেট চালু থাকতো। মাঝে মাঝে ফেসবুকে লাইভ দিয়ে দেশের সবাইকে দেখাতেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হালিমা আপার কথা আগেই বলেছি। আপার স্বামী কামাল ভাই আমার মেসেঞ্জারে কল দিতেন আপার সাথে কথা বলার জন্য। আপার অমায়িক ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর আমাদের দুই স্যারের কথা কি বলবো। ওনাদের তুলনা ওনারা দুজনেই। এবার মূল কথায় আসি।

গাড়ি প্রায় আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি। সকাল সাড়ে আটটায় আমরা ফিলিপাইনের শিক্ষা বিভাগের কেন্দ্রীয় অফিসে পোঁছলাম। সেখানে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হলো। আমাদের দুই স্যারের গলায় পরিয়ে দেয়া হলো মালা। সবাই সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ভেতরে ঢুকলাম।

আমাদেরকে একটা কনফারেন্স হলে বসানো হলো। সব অতিথিরা হাজির হওয়ার পর অনুষ্ঠানের মূল পর্ব আরম্ভ হলো। আমি যথারীতি পিছনের বেঞ্চে। শুরুতেই ফিলিপাইনের জাতীয় সংগীত বাজানো হলো। এরপর যখন পরিচিতি পর্ব শুরু করতে যাবে আমি জিজ্ঞেস করলাম আমাদের দেশের জাতীয় সংগীত কি শোনানো হবে না? এবার তাদের টনক নড়লো। আমাকে ডেকে বললেন, ইউটিউব থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত খুঁজে বের করে দিতে। আমি ইউটিউবে সার্চ দিয়ে আমাদের জাতীয় সংগীত খুঁজে দিলাম। পুরো হলরুমে উচ্চস্বরে বাজতে শুরু করলো“ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় দেশমাতৃকার প্রতি টান অনুভব করতে লাগলাম। চোখের কোণ বেয়ে কেন জানি অশ্রু নামছিল। ভিনদেশে নিজের দেশের জাতীয় সংগীত শুনতে কেমন লাগে সেটা উপলব্ধি না করলে বুঝানো সম্ভব না। জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পর বুঝতে পারলাম তাদের ভুলের জন্য তারা লজ্জা পেয়েছেন। এবার একে একে সবার পরিচিতি পর্ব শুরু হলো। বাংলাদেশের সবার পরিচিতি পর্ব শেষে ফিলিপাইনের শিক্ষা ডিপার্টমেন্টের সবার পরিচিতি পেলাম। তাদের পক্ষে প্রধান ছিলেন শিক্ষা ডিপার্টমেন্টের সহকারী সচিব এলমা রুবি টরিও। তিনি আমাদের ফিলিপাইনের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিলেন। সে সাথে ফিলিপাইনের শিক্ষার স্তর সম্পর্কে অবহিত করলেন। তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য কি তা তুলে ধরলেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে ফিলিপাইনের শিক্ষা মিল-অমিল এসব নিয়ে আলোচনা করলেন। উভয় পক্ষই নিজ নিজ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভালো ভালো দিকগুলো তুলে ধরেছিলেন। এতে করে আমরা উভয় দেশের মানুষ একে অপরের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করলাম। সকাল ১০টায় আমাদের সভা শেষ হলে সবাই মিলে ফটোসেশন করলাম। আমাদের সাথে ছিলেন ইউপি ইউনিভার্সির প্রজেক্ট এসিসটেন্ট রেগ সিভিলা সিবাল। তিনি পুরোদিন আমাদের সাথে থেকে গাইডের কাজ করেছিলেন। আরো ছিলেন জেসন অর্নিডো। ফটোসেশন শেষে বিদায় নিয়ে বাইরে এলাম। এবার পরবর্তী মিশন ইউপি ইটিগ্রেটেড স্কুল পরিদর্শন।-(চলবে)

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট