চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পর্ব-১১ঃ ইউনিভার্সিটি অফ দ্যা ফিলিপাইন্সে প্রশিক্ষণ (বাকি অংশ)

মো. ফারুক ইসলাম

২০ জুন, ২০২০ | ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

প্রশিক্ষণের প্রথম সেশন শেষ হয় দুপুর বারোটায়। এরপর আমাদের দুপুরের খাবারের বিরতি দেয়া হলো। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেনটিজ হলের সামনে যখন এসে দাঁড়ালাম, তখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। আবহাওয়া ছিল ঠাণ্ডা। বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে অনেকটা মিল। বাংলাদেশে জুন মাসে গরম পড়লেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ে। ফিলিপাইনেও একই অবস্থা। জেসন অর্নিডো আর এন্না কারিন্না এস. বাতিস্তা আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন খাবারের দোকানে। রাস্তার পাশে খাবারের দোকান। বাহির থেকে দেখে মনে হলো বাংলাদেশের গ্রামের কারো ছোট ঘর। ভিতরে ঢুকে দেখলাম অনেক পরিপাটি। সেমিপাকা ঘরে খাবারের দোকান। দুইজন মহিলা আর একজন পুরুষ খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত। আমাদের দেখে অভ্যর্থনা জানালেন। সবাই নিজ নিজ প্লেটে খাবার নিলাম। ভাত, সবজি জাতীয় কিছু খাবার। সত্যি বলতে কি এমন খাবার আমি জীবনে প্রথমবার খেয়েছি। তাই খাবারের বর্ণনা সঠিকভাবে দিতে পারবো না। এটা খেতে হচ্ছে বলেই খাওয়া। তা না হলে খেতাম না। কারণ কি খাচ্ছিলাম নিজেরাও জানি না। কিছুক্ষণ এটা খাই, কিছুক্ষণ ওটা। কিন্তু মন ভরে না। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের বেগুনি আর কিছু পাতা জাতীয় খাবার খাচ্ছি। এরপরও খেলাম। কারণ যেদেশে আছি সেদেশের খাবার আমাদের দেশের সাথে মিল থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, প্রশিক্ষণ চলাকালীন দুপুরের খাবারের বিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হতো। কিন্তু বাইরে স্কুল পরিদর্শনে গেলে খাবারের বিল নিজেকে বহন করতে হতো। এ ব্যাপারে পরবর্তী পর্বগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এক ঘণ্টার বিরতি শেষে আমরা পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিতে।


দুপুর দেড়টার দিকে প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় সেশন আরম্ভ হয়। দ্বিতীয় সেশনের আলোচ্য বিষয় ছিলো স্পেশাল এডুকেশন এরিয়া। প্রশিক্ষক ছিলেন মাইরা ত্রিনিদাদ টি. টানটেনগো। তাঁর সুন্দর উপস্থাপন আর মনোমুগ্ধকর লেকচার অনেক ফলপ্রসূ ছিলো। প্রতিটি পর্বের লেকচার শেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হতো। যেহেতু আমরা বাংলাদেশ থেকে গেছি। তাই আমাদের জানার আগ্রহটা ছিলো বেশি। দুই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মিল-অমিল, ভিন্নতা সবকিছু জানতে আমরা মুক্ত আলোচনায় অংশ নিতাম। এতে করে ফিলিপাইন আর আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা চিত্র পেতাম। বিকাল সোয়া চারটার দিকে আমাদের দ্বিতীয় সেশন শেষ হলে প্রশিক্ষক বিদায় নেয়ার আগে আমাদের বললেন, মাগাডাং হাপন। মানে শুভ অপরাহ্ন। প্রথম দিনে দুটো শব্দ শিখে নিলাম। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে প্রশিক্ষণ চলাকালীন আমরা এই শব্দ দুটো ব্যবহার করতাম।
পৌণে পাঁচটার দিকে আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম। ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বাড়ির সবার সাথে কথা বলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। সাড়ে পাঁচটার দিকে গাড়িতে করে আমরা কেনাকাটা করতে বের হলাম। মার্কেটে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা ৬টা। আর বাংলাদেশ সময় তখন বিকাল ৪টা। মার্কেটে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পতাকা হাতে কয়েকটা ছবি তুললাম। এরপর কেনাকাটা শুরু করলাম। আমাদের টিম লিডার বাহারুল ইসলাম স্যার সবাইকে ৮টার মধ্যে কেনাকাটা শেষ করে মার্কেটের বাইরে মিলিত হতে বলেছিলেন।
ফিলিপাইনের সুপার মার্কেটগুলো অনেক বড়। অধিকাংশ সুপার মার্কেটে বেচা-বিক্রিতে আছেন মহিলারা। যেখানেই যাই মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশি। সুন্দর পরিপাটি শপিংমলে ফাস্ট ফুডের দোকান অনেক। একটা দোকানের সিটও খালি নেই। বুঝতে পারলাম ফিলিপাইনের লোকজন ফাস্ট ফুডে বেশি অভ্যস্ত। ভাত তারা খুব কমই খান। যতগুলো মার্কেট ঘুরেছিলাম সবগুলো মার্কেটের ২/৩ ফ্লোর জুড়ে ছিলো ফাস্ট ফুডের দোকান। সবগুলো দোকানে লোকজনের ভিড়। জিনিসপত্রের দাম বাংলাদেশের চেয়েও বেশি।

বাংলাদেশে ভালো মানের একটি টি-শার্ট হাজার-বারোশ’র মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু এই ধরনের টি-শার্ট ফিলিপাইনে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এরপরও দেশের বাইরে যখন এসেছি তখন প্রিয় মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা তো নিয়ে যেতে হবে। কার কার জন্য শপিং করবো এটা নিয়ে আমি প্রথমদিন একটা তালিকা তৈরি করেছিলাম হোটেলের রুমে বসে। এদিকে, বিশাল মার্কেটে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকেই পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমারও দেরি হয়েছিল বগুড়া জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা শামীমা আপার জন্য মোবাইল দেখতে গিয়ে। প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছিল। সবাই গাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের আসতে দেরি দেখে সবাই উৎকণ্ঠায় ছিলেন। তাছাড়া বান্দরবান জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সুইচিং মারমা ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এক ধরনের টেনশনে সবাই ভুগছিলেন। আসার পর বাহারুল ইসলাম স্যারের বকা শুনলাম। জানি বকাটা প্রাপ্য ছিল। দেরি হতো না। বগুড়া জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা শামীমা আপার ছেলে একটা শাওমি মোবাইলের নাম লিখে দিয়েছিল ওনার জন্য কিনতে। ছেলের আবদার পূরণ করতে গিয়ে আপা আমাকে নিয়ে মোবাইলের দোকানে দোকানে ঘুরছিলেন। মোবাইল পেলেও দাম ছিলো চড়া। ফিলিপাইনের মুদ্রায় ১৯ হাজার ৫০০ পেসো। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪০ হাজার টাকার কাছাকাছি। অথচ একই মোবাইল বাংলাদেশে ১৮ হাজার টাকা। আপাকে বুঝালাম ফিলিপাইন থেকে মোবাইল না নিতে। কারণ কোন সমস্যা হলে একে তো পরিবর্তন করা যাবে না। তার উপর কান্ট্রি কোড সেট করার ঝামেলাও ছিলো। দামও বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুনের বেশি। আপা বিষয়টা বুঝতে পেরে মোবাইল কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন। কিন্তু যে মোবাইল কেনার জন্য দেরি হয়েছিল, সে মোবাইল তো কেনায় হলো না উল্টো স্যারের বকা খেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গাড়িতে ওঠার পর কমল সরকার আর কমল বৈদ্য দাদা মন খারাপ করতে নিষেধ করলেন। দাদারা বললেন, তোমাকে সবাই খুব স্নেহ করেন। কারণ তুমি খুব মিশুক এবং সবার প্রিয়। অবশ্য গাড়ি ছাড়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। বাহারুল ইসলাম স্যার পরিবেশটাকে আবার স্বাভাবিক করে ফেলেছিলেন। আসলে স্যারের মতো অসাধারণ ভালো মনের মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছি। স্যারের স্নেহের তুলনা হয় না। যেখানেই যেতেন আমার সাথে সব সময় মজা করতেন। বাংলাদেশে আসার পরও ডিপার্টমেন্টাল কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হলে স্যারের শরণাপন্ন হই। এদিকে, সুইচিং মারমা নাকি একলা হোটেলে চলে গিয়েছিলেন। তার কাছে প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুনের নম্বর ছিলো। ওই নম্বরে যোগাযোগ করে তিনি প্রাইভেট গাড়িতে করে হোটেলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ফিলিপাইনে মার্কেটের বাইরে বেশিক্ষণ গাড়ি পার্কিং করে রাখলে ১২০০ পেসো জরিমানা গুনতে হয়। সেজন্য ড্রাইভার নিজেও টেনশনে ছিলেন, যদি জরিমানা গুনতে হয় তখন কি হবে। তাই সব মিলিয়ে মার্কেটের সময়টা ভালো ছিলো না বললেই চলে। রাত সাড়ে নয়টার দিকে আমরা হোটেলে ফিরে আসি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট