চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

টাইগারদের রেকর্ডগড়া জয়

সাকিবে অনন্য বাংলাদেশ

মিটু বিভাস

১৮ জুন, ২০১৯ | ২:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বিশ^সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের দুরন্ত শতক এবং লিটন দাশের মহাকাব্যিক ইনিংসে কুপোকাত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ^কাপের স্বপ্নযাত্রায় গতকাল রেকর্ড গড়ে ক্যাবিবীয়দের ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেমিফাইনালের স্বপ্ন ভালভাবেই টিকিয়ে রেখেছে টাইগাররা। টনটনে দ্য কুপার এসোসিয়েটস কাউন্টি গ্রাউন্ডে শুরুতে টাইগার বোলারদের আগ্রাসনের পরও লুইস, হোপ ও হেটমায়ারদের স্বরূপে ফেরায় রানের পাহাড়ে চাপা পড়ার শংকায় ছিল বাংলাদেশ। তবে শেষ দিকে মুস্তাফিজরা রানের লাগাম আটকে রাখলে ৮ উইকেটে ৩২১ রানে শেষ হয় উইন্ডিজ ইনিংস। টনটনের ছোট মাঠে জিততে হলে রেকর্ড গড়তে হবে এমন সমীকরণে খেলতে নেমে ক্যারিবীয় বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা করলেন সাকিব-তামিমরা। ক্যারিবীয় গতি, সুইং আর বাউন্সারের মোক্ষম জবাব দিলেন ব্যাট হাতে। নির্ধারিত ৫০ ওভারের ৫১ বল হাতে রেখেই ৩ উইকেট হারিয়ে কাঙ্খিত জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। এবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডেতেই নিজেদের সর্বোচ্চ রানের স্কোর গড়ে এবারের বিশ্বকাপ শুরু করেছিল বাংলাদেশ। সেই টাইগাররা কাল গড়ল আরেক কীর্তি। ওয়ানডেতে নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড। বিশ্বকাপের মতো আসরেই এটি আবার যেকোনো দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড। এর আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জয়ের রেকর্ডটি ছিল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১৫ সালে নেলসনে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ৩১৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছিল বাংলাদেশ। এ জয়ে তালিকার ৮ নম্বর থেকে ৫ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। আর ৩ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার ৭ নম্বরে নেমে গেল ওয়েন্ট ইন্ডিজ। দুর্দান্ত এ জয়ের পথে সাকিব খেলেছে অপরাজিত ১২৪ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস। মাত্র দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরির কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন সাকিব। কাল দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে টানা দুই সেঞ্চুরির সাথে করেছেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরিও। অন্যদিকে বিশ^কাপের অভিষেকটা স্মরণীয় কর রাখলেন লিটন দাস। মো. মিথুনের পরিবর্তে গতকাল সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমান করলেন তিনি। অভিষেক ম্যাচেই অর্ধশতকসহ খেললেন অপরাজিত ৯৪ রানের এক দুরন্ত ইনিংস। নিজেদেরর ব্যক্তিগত এতো রেকর্ডের সঙ্গে সাকিব-লিটন গড়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে আরও একটি রেকর্ড। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে এখন সর্বোচ্চ রানের জুটি এই দুইজনের। সঙ্গে দেশের ইতিহাসেও চতুর্থ উইকেট জুটিতে সবচেয়ে বড় জুটির রেকর্ড গড়েছেন এই দুই জন। এর আগের সর্বোচ্চ রানের জুটিতেও ছিলো সাকিবের নাম। এই বিশ্বকাপেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে পঞ্চম উইকেট জুটিতে ১৪২ রানের জুটি গড়েন সাকিব। মাত্র দুই ম্যাচ বাদেই এই রেকর্ড ভাঙলেন সাকিব ও লিটন। গড়েছেন ১৮৯ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি।
গতকাল সকাল থেকেই টনটনের আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। এরপর শুরু হয় মেঘ-রোদের লুকোচুরি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মিলে রোদের হাসি। আর সে আলোতেই যেন উদ্ভাসিত হল বাংলাদেশ। বিশ^কাপে ক্যারিবীয়দের অগ্রযাত্রা সংকীর্ণ করে দিয়ে টাইগাররা তুলে নিল এক অনন্য জয়। টনটন ভেন্যুর দর্শক ধারণ ক্ষমতা ছিল দশ হাজারেরও কম। এরমধ্যে অধিকাংশ ছিল লাল-সবুজের সমর্থক। সাকিব-লিটনে চার-ছক্কার ফুলঝুড়িতে পুরো বাংলাদেশ ইনিংস এ দর্শকরাই যেন উৎসবে মেতেছিলেন। টনটনে বড় টার্গেট তাড়ায় নেমে দলকে ভালো শুরু এনে দেন তামিম ইকবাল এবং সৌম্য সরকার। রানের জন্য লড়ছিলেন তামিম, অন্যপ্রান্তে সৌম্য সাবলীল ব্যাটিং করে যাচ্ছিলেন। নবম ওভারের প্রথম বলে আন্দ্রে রাসেলকে পয়েন্টের ওপর দিয়ে দারুণ এক ছক্কা মারলেন সৌম্য। পরের বলেই ক্যাচ তুলে দিলেন স্লিপে। ২৩ বলে ২ চার ২ ছক্কায় ২৯ রান করা সৌম্যর বিদায়ে ভাঙে ৫২ রানের ওপেনিং জুটি। সৌম্যর আউটের পর হাত খুলতে থাকেন তামিম। সাকিবকে সঙ্গী করে এগিয়ে নিতে থাকেন দলের স্কোর। দ্বিতীয় উইকেটে ৬৯ রানের জুটি গড়ার পর হঠাৎ ছন্দপতন। শেলডন কটরেলকে এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান ৪৭তম হাফ সেঞ্চুরি থেকে ২ রান দূরে থাকা তামিম। কটরেল নিজেই সরাসরি থ্রোতে তামিমের স্টাম্প ভেঙে দেন। রানআউট হওয়ার আগে ৫৩ বলে ৬টি চারে ৪৮ রান করেন তামিম। এরপর থমাসের করা স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে খোঁচা মেরে শাই হোপের গ্লাভসবন্দি হন ১ রান করা মুশফিক। টানা দুই ওভারে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু সেখান থেকে ব্যাট হাতে অন্য এক গল্প লিখলেন দুই টাইগারা। আর এ গল্পটা শুধু সাকিব লিটনের। ক্যারিবীয় বোলারদের বিপক্ষে ধীরে ধীরে চড়াও হতে থাকে এ জুটি। ২১তম ওভারের প্রথম বলে আন্দ্রে রাসেলকে ফ্লিক করে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে ফিফটি করেছেন সাকিব আল হাসান। ৪০ বলে পঞ্চাশ স্পর্শ করতে ৭টি চার মারেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। ৩০তম ওভারে দলীয় রান ২০০ অতিক্রম করে বাংলাদেশের। ৩৪তম ওভারের শেষ বলে ওশান থমাসকে কভার ড্রাইভ করে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে বিশ^কাপে নিজের দ্বিতীয় শতক তুলে নেন সাকিব আল হাসান। দুই ওভার পরেই কটরলকে মিডউইকেটে ঠেলে দিয়ে অর্ধশতক তুলে নেন লিটন দাস। শেষ পর্যন্ত আর কোন সাফল্য পায়নি ক্যারিবীয় বোলাররা। সাকিব লিটন অপরাজিত থেকে দলকে জয় এনে দিয়ে মাঠ ছাড়নে। ১৭০ বলে ১৬টি চারে ১২৪ রানে অপরাজিত থাকেন সাকিব। অন্যপ্রান্তে ৬৯ বলে ৮টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৯৬ রানে অপরাজিত থাকেন লিটন দাস। দুর্দান্ত এ জয়ের পরও আফসোস করতে পারেনি লিটন। কারণ টার্গেটটা আরেকটু বড় হলে সেঞ্চুরিটাও তিনি পেতে পারতেন। কারণ ৫১ বল আগেই যে শেষ হয়ে গেছে ম্যাচ। উইন্ডিজের পক্ষে থমাস ও রাসেল ১টি করে উইকেট নেন।
ইংল্যান্ডের টনটনের এমন ছোট মাঠে বড় লক্ষ্য হলেও জয় তুলে নেয়া সম্ভব। আর তাই টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলপতি মাশরাফি মর্তুজা। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই বাংলাদেশি বোলারদের তোপের মুখে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টাইগার দলপতি মাশরাফি বিন মর্তুজার প্রথম ওভারে কোনো রান নিতে পারেননি ক্যারিবীয় দুই ওপেনার ক্রিস গেইল আর এভিন লুইস। পরের ওভারে সাইফউদ্দীনও ২ রানের বেশি দেননি। তৃতীয় ওভারে এভিন লুইসের কাছে মাত্র একটি বাউন্ডারি হজম করেন মাশরাফি। তার পরের ওভারে দ্বিতীয় বলেই আঘাত সাইফউদ্দীনের। অফসাইডে বেরিয়ে যাওয়া বল বুঝতে না পেরে একটু খোঁচা দিয়েছিলেন গেইল। উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহিম ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন। এ নিয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে চার ম্যাচে দুবারই শূন্যতে আউট হলেন বিধ্বংসী এই ওপেনার। ৬ রান তুলতেই ভাঙে উদ্বোধনী জুটি। কিছুটা বিপদেই পড়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখান থেকে ইনিংস মেরামতের দায়িত্ব নেন এভিন লুইস আর শাই হোপ, দ্বিতীয় উইকেটে তারা যোগ করেন ১১৬ রান। থিতু হয়ে গিয়েছিল জুটিটা, চোখ রাঙানিও দিচ্ছিল। ২৫তম ওভারে এসে টাইগার শিবিরে স্বস্তি ফেরান সাকিব আল হাসান। তাকে তুলে মারতে গিয়ে লং অফে বদলি ফিল্ডার সাব্বির রহমানের ক্যাচ হন লুইস। ৬৭ বলে ৬ বাউন্ডারি আর ২ ছক্কায় ক্যারিবীয় ওপেনার করেন ৭০ রান। তৃতীয় উইকেটে নিকোলাস পুুরান আর সিমরন হেটমায়ারের ৩৭ রানের জুটিটিও ভাঙেন এই সাকিব। টাইগার স্পিনারের ঘূর্ণিতে ৩০ বলে ২৫ রান করে লং অনে সৌম্য সরকারের ক্যাচ হন পুরান। ১৫৯ রানে ৩ উইকেট হারায় ক্যারিবীয়রা। সেখান থেকে ৪৩ বলে ৮৩ রানের বিধ্বংসী এক জুটি হেটমায়ার-শাই হোপের। কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছিল না। অবশেষে মুস্তাফিজ ঝলক দেখান। ৪০তম ওভারে এসে জোড়া আঘাত হানেন কাটার মাস্টার। মুস্তাফিজের ওভারের তৃতীয় বলটি মিড উইকেটে ভাসিয়ে দেন হেটমায়ার। ২৫ বলে ৫০ রানের টর্নোডো ইনিংস খেলা এই ব্যাটসম্যান হন তামিম ইকবালের চোখে লাগার মতো এক ক্যাচ। ওভারের শেষ বলটিতে দুর্দান্ত এক ডেলিভারি দেন মুস্তাফিজ, শূন্য রানেই আন্দ্রে রাসেল ধরা পড়েন উইকেটের পেছনে। ২৪৩ রানে ৫ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখান থেকে ষষ্ঠ উইকেটে আরেকটি ঝড়ো জুটি ক্যারিবীয়দের। এবার হোপের সঙ্গী অধিনায়ক জেসন হোল্ডার, ১৫ বলে ৩৩ রানের ঝড় তুলে ক্যারিবীয় অধিনায়ক আউট হন সাইফউদ্দীনের বলে, লং অফে ক্যাচ নেন মাহমুদউল্লাহ। তারপরও একটা প্রান্ত ধরে ছিলেন শাই হোপ। বল খরচ করলেও যাচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। শেষ পর্যন্ত আর তাকে সেঞ্চুরি বঞ্চিত করেন কাটার মাস্টার।। ১২১ বলে ৯৬ রান করে মুস্তাফিজের শিকার হন হোপ। শেষ ৬ ওভারে টাইগার বোলাররা বেশ চেপে ধরেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এর মধ্যেও টুকটাক বাউন্ডারি মেরে রান এগিয়ে নিয়েছে তারা। শেষ ওভারের শেষ বলে ড্যারেন ব্রাভোকে (১৫ বলে ১৯) বোল্ড করেন সাইফউদ্দিন। বাংলাদেশের পক্ষে ৩টি করে উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ আর সাইফউদ্দিন। বাকি ২টি উইকেট নেন সাকিব।
উইন্ডিজ ৩২১/৮ (৫০/৫০)
ব্যাটিং
ক্রিস গেইল-কট মুশফিক বল সাইফুদ্দিন- ০
এভিন লুইস-কট সাব্বির বল সাকিব- ৭০
শাই হোপ-কট লিটন বল মুস্তাফিজ- ৯৬
নিকোলাস পুরান-কট সৌম্য বল সাকিব- ২৫
শিমরন হেটমেয়ার-কট তামিম বল মুস্তাফিজ- ৫০
আন্দ্রে রাসেল-কট মুশফিক বল মুস্তাফিজ- ০
জেসন হোল্ডার-কট মাহামুদউল্লাহ বল সাইফুদ্দিন- ৩৩
ড্যারেন ব্র্যাভো- বোল্ড সাইফুদ্দিন-১৯
ওশানে থমাস-অপরাজিত -৬
বোলিং
বোলার-ওভার-রান-উইকেট
মাশরাফি-৮-৩৭-০
সাইফুদ্দিন-১০-৭২-৩
মুস্তাফিজ -৯-৫৯-৩
মেহেদী মিরাজ-৯-৫৭-০
মোসাদ্দেক -৬-৩৬-০
সাকিব -৮-৫৪-২
বাংলাদেশ ইনিংস :৩২২-৩(৪১.৩/৫০)
ব্যাটিং
তামিম ইকবাল- রানআউট (কটরেল)-৪৮
সৌম্য সরকার-কট গেইল বল রাসেল-২৯
সাকিব আল হাসান-অপরাজিত-১২৪
মুশফিকুর রহিম-কট হোপ বল থমাস-১
লিটন দাস-অপরাজিত-৯৪
বোলিং
বোলার-ওভার-রান-উইকেট
কটরেল-১০-৬৫-০
হোল্ডার-৯-৬২-০
রাসেল-৬-৪২-১
গ্যাব্রিয়েল ৮.৩-৭৮-০
থমাস-৬-৫২-১
গেইল-২-২২-০

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট