চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দৃষ্টিহীন চোখে ক্রিকেট-আলো

হুমায়ুন কবির কিরণ

১২ জানুয়ারি, ২০২১ | ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ

মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করা মোহাম্মদ আসমত আলী ক্রিকেট খুব ভালোবাসেন। কিন্তু এই পৃথিবীর রঙিন সব দৃশ্য তো দূরের কথা, সাদাকালোও উপস্থিত নেই তাঁর জীবনে। পুরোটাই আঁধার। কিন্তু জীবন চলার পথে দৃষ্টিহীনতার প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

ঘরের উঠোনে নিজে থেকেই অনুশীলন, ধীরে ধীরে অন্ধদের বিশেষ ক্রিকেট রপ্ত করে বাংলাদেশে জাতীয় দলের সূচনা থেকেই আছেন মূল দলে। দায়িত্ব পালন করছেন যশোর জেলা দলের অধিনায়কেরও। হতাশা নয় পারিবারিক চালের ব্যবসা যতটা সম্ভব প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে দেখাশোনা করে পরিবারকে সাহায্য করেন আর স্বপ্নের ক্রিকেটে আলো খুঁজে বেড়ান অন্ধ আসমত আলী।

স্বাভাবিক ক্রিকেটের কথা অন্যদের মুখ থেকে জানলেও কখনোই তার স্বাদ নেওয়া হয়নি। তবে যে ক্রিকেটে আছেন তাতে যদি একটি বিশ্বকাপ জেতা দলে নিজের নাম লেখাতে পারেন, আর কিছু চাওয়ার নেই। আসমত আলীসহ শেখ আবু নাসের ব্লাইন্ড ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলতে অন্যান্যের সাথে বর্তমানে চট্টগ্রাম অবস্থান করছেন চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কক্সবাজার জেলা দলের অধিনায়করাও। এঁদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট জাতীয় দলের ও চট্টগ্রাম জেলা দলের অধিনায়ক তানজিলুর রহমান সিদ্দিকী, জাতীয় দলের সদস্য ও ঢাকা জেলা দলের অধিনায়ক আশিকুর রহমান বাঁধন ও জাতীয় দলের সদস্য এবং কক্সবাজার জেলা দলের অধিনায়ক মোহাম্মদ ফয়সাল। ১০ জানুয়ারি শুরু হওয়ার দিনে নির্ধারিত দুটি ম্যাচ শেষে সাগরিকা মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে কথা হয় যশোরসহ চারটি জেলা দলের অধিনায়কদের সাথে।

মাগরেবের ওয়াক্ত পেরিয়ে নামাজ আদায় শেষ, খোলা পরিবেশে কিছু নিয়নবাতির ঝাড়বাতি আলো ছড়ালেও ঘুটঘুটে অন্ধকারকে তা হারাতে পারেনি। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না চার অধিনায়কের। কারণ তাঁদের জীবন ২৪ ঘন্টাই আঁধারে ঠাসা। অবশ্য এই আঁধারের মধ্যে অনেক সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের চাইতেও তাঁরা প্রাণোচ্ছ্বল। ১০ তারিখের ম্যাচে জয় পাওয়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের অধিনায়কের মুখচ্ছবি জয়ের হাসি আর পরাজয়ে মলিন হলেও যশোর ও কক্সবাজার জেলা দলের অধিনায়কের মুখে পরের ম্যাচে ভালো করার প্রত্যয়। আঁধারের মাঝেও কেমন যেন আলোর ছটা, দৃষ্টিহীনতার কঠিন বাস্তবতাকে একপাশে রেখে ক্রিকেটের মাঝে আলো পাওয়ার আনন্দেই হবে।

তানজিলুর রহমান সিদ্দিকীর বাড়ি কুতুবদিয়ায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স করা জন্মান্ধ এই তরুণ স্বনির্ভর।

প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে কর্মরত তানজিলুর জানান, ২০১০ সাল থেকেই আছেন ব্লাইন্ড ক্রিকেটে। জাতীয় দলে খেলছেন ২০১২ সাল থেকে। আশিকুর রহমান বাঁধন কিছুটা দেখতে পান। বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে থাকাকালীন আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনিতে টেপ টেনিসবল ক্রিকেট খেলার সময় একটি বল সজোরে চোখে লাগার পর থেকেই দৃষ্টিশক্তি প্রায় নষ্ট হয়ে যায় তাঁর।

একটা সময় স্বাভাবিক ক্রিকেট খেলেছেন। তাই কিছুটা হতাশা মোড়ানো কন্ঠেই বললেন, মাঝেমধ্যে আগের মতো ক্রিকেট খেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছায় সেটাতো আর সম্ভব নয়। তবে কোন ক্যাম্পে বা এই চলছে টুর্নামেন্ট এমন আসরে আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা একত্রিত হয়ে খেলার মধ্যেই কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করি। বিবিএ সম্পন্ন করা এই তরুণ আগে একটি ফার্মে চাকরি করলেও বর্তমানে পারিবারিক ব্যবসায় সময় দেওয়ার সাথে সাথে ক্রিকেট খেলে বেড়াচ্ছেন।

তানজিলুর এবং আশিকুর দুজনেরই আন্তর্জাতিক ব্লাইন্ড ক্রিকেটে সেঞ্চুরির মত অর্জন আছে, তাও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিরুদ্ধে। কক্সবাজারে মোহাম্মদ ফয়সাল ও মোহাম্মদ আসমত আলী দুজনেই বি-১ শ্রেণির ক্রিকেটার। এই দুনিয়ার সবকিছুই তাদের চোখে কালো হলেও মনের রঙিন আলোয় তারা নিজেরাই আলোকিত। টেকনাফে বসবাস করা ফয়সালও পারিবারিক ব্যবসায় সময় দেন। ২০১২ সাল থেকে ব্লাইন্ড ক্রিকেটের সাথে থাকা ফয়সাল স্বপ্ন দেখেন বিশ্বকাপ জয়ের।

২০০০ সালের ১২ নভেম্বর পথচলা শুরু বাংলাদেশ ব্লাইন্ড ক্রিকেট কাউন্সিল (বিবিসিসি)’র। তবে ১৭ মে ২০০৮ সালে বিবিসিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি লায়ন দিদারুল আলম চৌধুরী বর্তমানে কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তিনি জানান, প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কাজ করছে এমন কিছু সংস্থা খেলোয়াড়দের সাহায্য সহযোগিতা করলেও সরকারের কোনো পর্যায় থেকে আর্থিক অনুদান পায় না বিবিসিসি।

বিদেশ সফর থেকে শুরু করে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও লিগ আয়োজন করা হয় ব্যক্তিগত তহবিলের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। এ জন্য সবার আগে তিনি স্মরণ করেন সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের কথা। এছাড়া পরিচালকদের মধ্যে নিয়মিত সহযোগিতা করছেন সিরাজুল ইসলাম, মইন ইকবাল, কুদরত-ই খোদা দুলু, জাহিদ হোসেন, সানোয়ার আহমেদ, ফজলে রাব্বি মোফাশা।

এখানে উল্লেখ্য ব্লাইন্ড ক্রিকেটে প্রতি একাদশে বি-১ ক্যাটাগরির (পুরোপুরি অন্ধ) কমপক্ষে ৪ জন, বি-২ ক্যাটাগরির (৬ থেকে ১০ গজ দূরত্বে দেখতে পান) ৪ জন ও বি-৩ ক্যাটাগরির (১৫ থেকে ২৫ গজ দেখতে পান) ৩ জন ক্রিকেটার থাকেন। ব্লাইন্ড ক্রিকেটে ওয়ানডে হয় ৪০ ওভারের, টেস্ট ম্যাচ তিন দিনে। বি-১ ক্রিকেটার যত রান নেন স্কোরবোর্ডে তার ডাবল যোগ হয়।

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট