চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আম্মা

নাজমুস সাকিব রহমান

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:৫২ অপরাহ্ণ

মেীরি, আমার আম্মাকে তুমি চেনো। তার একটা নাম আছে- নাজিয়া হাসান। দুর্ভাগ্যবশত তাকে কেউ এই নামে ডাকে না। তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো, বাচ্চা হওয়ার পরপরই মায়েরা নিজের নাম হারানো শুরু করে। বলা যায়, আমি ও আমার দুই বোনের কারণে আম্মা নিজের নাম হারিয়ে ফেলেছেন। এখন তাকে কেউ নাম ধরে গালি দেয় না।

আমি তোমাকে আজ আম্মা বিষয়ক কিছু গল্প বলবো। আমার আম্মা আপাদমস্তক গৃহিণী, খবরের চ্যানেলগুলোর মতো। ব্রেকিং নিউজ দিতে পছন্দ করেন। প্রায়ই তাকে বলতে শুনি, অমুকের ছেলে বিসিএস হয়েছে, তমুকের মেয়ে ডাক্তার। তার এইসব নিউজ আমরা পছন্দ করি না। অথচ এইসব নিউজ দিতে দিতেই সম্প্রতি তিনি বয়সে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন।

আম্মার জন্মদিন উপলক্ষে আমরা ভাই-বোনরা প্রথমবারের মতো তার জন্মদিন পালন করলাম। কেক কাটলাম। বাসার ভেতর একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান হলো। আমরা আম্মাকে নিয়ে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ করলাম। মৌরি, আমি তোমাকে এখন সে ব্যাপারে বলব। স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে প্রথম কথা বললেন আব্বা। তিনি কি বললেন জানো?

‘তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে মায়ের জন্মদিন পালন করছ, এই জন্য আমি রাগ করেছি। গত ত্রিশ বছর ধরে তোমাদের সঙ্গে আছি। পরিবারের জন্য আমি কি করিনি? ভুলে গেলে চলবে না তোমরা যতটুকু মায়ের, ততটুকু আমার। তোমাদের কি উচিত ছিল না প্রথমে আমার জন্মদিন পালন করা? আমার জন্য কি শুধুই বাবা দিবস?’

আব্বা দূরে চলে যাচ্ছিলেন। অর্ষা তাকে থামাল। বলল, ‘এসব কি আব্বু? তুমি তো পলিটিশিয়ানদের মতো কথা বলছো। আরেকটু হলেই নির্বাচনে চলে যাবে। এরচেয়ে তোমাদের বিয়ের গল্প বলো। ওইসময় তো আমরা কেউ ছিলাম না। তোমরা দুজন কি কখনো ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করেছো? আমার তো মনে হয় না। এখন আবার বলো না, তখন লোডশেডিং হতো বলে প্রতিদিনই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার ছিল। আমি তো তোমাকে চিনি’।

আব্বা বললেন, ‘তোমাদের মাকে যখন আমি বিয়ে করি, তখন সে বাতাস আসলে উড়ে যেত। সেদিন ওষুধ খুঁজতে গিয়ে তার প্রেসক্রিপশন দেখলাম। সেখানে লেখা- তার ওজন এখন ৭০ কেজি হয়েছে। তবে তোমরা যদি জানতে চাও, বিয়ের সময় তোমাদের মা কেমন সুন্দর ছিলেন আমি বলতে পারব না। ধারণা দিতে পারি। তার অবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির মতো। ভাবাই যায় না’।

আব্বা কথা শেষ করলেন। এরপর বর্ষার পালা। মৌরি, বর্ষাকে তুমি চেনো। আমার মেঝো বোন। ও যে বছর জন্মায়, সে বছরই চট্টগ্রাম শহর প্রথমবার পানিতে ডুবে যায়।

সে বলল, ‘আমি কিছুদিন আগের একটা ঘটনা বলবো। আম্মা তখন প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হন। আর ফেরার সময় আমাদের বাসার পাশে আরএফএলের যে শোরুমটা আছে, সেখানে ঢুঁ মারেন। যা পান তাই নিয়ে আসেন। এক সপ্তাহ এরকম চলল। আম্মার জন্য আমি কাঁচের গ্লাস ভাঙার আনন্দ ভুলে গেলাম।

এক সকালে দেখলাম, তিনি বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। চুপচাপ বসে আছেন। আমি খুবই অবাক হলাম। কী সমস্যা আম্মার? আমি তাকে বললাম, আম্মা, আপনি আজ প্লাস্টিক কিনতে যাবেন না? তিনি খুব মন খারাপ করে বললেন, না। ওরা ডিসকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।

এই কথা শুনে আমি হাসবো না নরমাল থাকবো বুঝতে পারলাম না। আসলে আম্মার জীবনটাই আমাদের জন্য ডিসকাউন্ট। আমি ঠিক করেছি, আমরা ছোট থাকতে আম্মার যে জন্মদিনগুলো পালন করা হয়নি, এখন থেকে সেগুলোও পালন করবো’।

বর্ষার কথা এখানেই শেষ। মৌরি, তুমি কি বুঝতে পেরেছো আম্মাকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভ্রান্ত করা যায়? আমার ছোট বোন অর্ষাকে তুমি দেখোনি। এখনো স্কুলে যায়। ওর কথা শুনলে তুমি দ্বিমত পোষণ করবে। কারণ আম্মাও তার সন্তানদের বিভ্রান্ত করতে পারেন। অর্ষা কী বলল শোনো :

‘লাস্ট বৃহস্পতিবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। হুট করে আম্মু এসে হাজির। বুঝলাম আমাকে পাহারা দিতে এসেছে। পাখা কতোটুকু গজিয়েছে দেখবে। তো, আম্মু অনেকক্ষণ পাশের বাসার বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকল। কী যেন ভাবল। একটু পর বলল, পাশের বাসার মেয়েটার মনে হয় অসুখ।

আমি বললাম, কীভাবে বুঝলে?

আম্মু বলল, মেয়েটার কাপড় ধোয়ার অভ্যাস আছে। প্রত্যেকদিন দেখি কাপড় ধোয়, আর শুকাতে দেয়। আজ দেয়নি। দ্যাখ- মেয়েটার বারান্দায় কোনো কাপড় নেই।

আম্মুর যে মাঝে মাঝে কী হয়, কথা একটা বলে পুরো কনফিউজ করে দেয়। মেয়েটার বারান্দায় কাপড় নেই- এটা কোনো কথা হলো’!

অর্ষার স্মৃতিচারণ শেষ। সবশেষে আমি কথা বলার সুযোগ পেলাম। ‘আমি খেয়াল করেছি, আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবারে মাঝে মাঝে ছয় কাপ চা বানানো হয়। একবার না, কয়েকবার ঘটনাটা ঘটেছে। এক কাপ চা আম্মা অতিরিক্ত বানান। রহস্যটা জানতে আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা কাহিনিটা কি বলেন তো? চা এক কাপ বেশি বানান কেন? আপনি কি বয়সের কারণে ভুলে যাচ্ছেন আমরা মানুষ পাঁচজন? আপনাকে কি ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হবে?

আম্মা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারে-কাছেও গেলেন না। নির্বিকার গলায় বললেন, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ছেলেমেয়ে চারজন। একজন কম হয়ে গেছে। এক কাপ চা ওর জন্য বানাই। তোদের সমস্যা হলে বানাব না’।

মৌরি, আমাদের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান এতোটুকুই। আচ্ছা, তুমি কি খেয়াল করেছো, এত বড় একটা চিঠি লিখলাম, কিন্তু আম্মার কোনো বক্তব্য রাখিনি? আমরা আসলে এরকমই। আমাদের সবকিছু মাকে নিয়ে, কিন্তু আমরা কখনো তার কথা শুনি না। তাকে বলতেও দিই না। এটাতেই আমাদের আনন্দ।

তবে তোমাকে এসব বলার গোপন কারণ আছে। কারণটা এখন ফাঁস করে দিচ্ছি। তুমি কি চার নম্বর কাপটার চা খেতে আমাদের পরিবারের সদস্য হতে পারো?

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট