চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

উদ্বিগ্ন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা

গাড়ি থেকে চুরি হচ্ছে রপ্তানি পোশাক

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:২৮ অপরাহ্ণ

মিজানুর রহমান

গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা গার্মেন্টস লিমিটেডের রপ্তানি পোশাক বোঝাই একটি কাভার্ডভ্যান ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কাভার্ডভ্যানটি ঢাকা—চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী ছাগলনাইয়া এলাকায় থামিয়ে পোশাক চুরি করছিলেন চোরাকারবারী চক্রের সদস্যরা। এ সময় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব সদস্যরা ৫ চোরকারবারিকে গ্রেপ্তার করেন।
চুরির ঘটনা শুধু এটি নয়। ঢাকা—চট্টগ্রাম মহাসড়কে এরকম চুরির ঘটনা ঘটেছে আরো। র‌্যাব সদস্যরা নারায়ণগঞ্জের পরিত্যক্ত একটি স্টিল মিল থেকে অন্য একটি চক্রের ৬ সদস্যকে আটক করেন সম্প্রতি। সেখান থেকে ৪১ বস্তা ও ৫০৬টি কার্টনভর্তি চুরি যাওয়া রপ্তানি গার্মেন্টস পণ্য উদ্ধার করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা।
চুরির সংখ্যা বাড়ছেই : বিজিএমইএর তথ্য অনুসারে, মহাসড়কে চুরির ঘটনা বাড়ছে। ২০১৯ সালে এই ধরনের ২টি ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে এমন ৯টি ঘটনা ঘটে। আর ২০২১ সালে অন্তত ৩০টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুরির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ ক্রেতাদের আস্থা হারানো ও সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ হারানোর ভয়ে অনেক রপ্তানিকারক বিষয়টা তাদের জানান না।
২০২১ সালে চট্টগ্রাম—ঢাকা মহাসড়কে অন্তত ৩০টি কাভার্ডভ্যান থেকে রপ্তানি পোশাক চুরির ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে গত ১৮ মার্চ উয়েস্ট নিট ওয়্যারের ১৫ হাজার ১৭৮ পিস জ্যাকেট, ২৩ মার্চ একই প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার জ্যাকেট, একই দিনে ২০ হাজার ১০০ জ্যাকেট কাভার্ডভ্যান থেকে চুরি করা হয়। জ্যাকেটগুলো আমেরিকা, ইতালি, জাপান ও জার্মানিতে রপ্তানি করা হয়। একইভাবে— গত ৫ মে আদমজীর ইয়েস্টার জিন্স লিমিটেডের ৬ হাজার, ৮ জুন গাজীপুরের টেকনো ফাইভারের ৯ হাজার ২৭০, ৫ জুলাই আশুলিয়ার ইভ ড্রেস শার্টসের ৩ হাজার, ২৯ এপ্রিল গাজীপুরের এপিএস নিট কম্পোজিটের ৩ হাজার ৭০৫, ৫ মে ফতুল্লার ফেইম এপারেলসের ৩০ হাজার ৫৪৩, ১২ এপ্রিল ফতুল্লার নেক্সট কম্পোজিটের ২ হাজার ২৩২, ১২ জুলাই আরমানা এপারেলসের ৯ হাজার ৯০ পিস পোশাক চুরি হয়।
একই দিনে গাজীপুরের সীরক এপারেলসের ৫২৩, কাইজার নিটওয়্যারসের ২ হাজার ৭৯৯, ৬ জুলাই গাজীপুরের এভার ফ্যাশনের ১ লাখ ১ হাজার ২১৪, ১১ মে আশুলিয়ার জয়শ্রী নিটওয়্যারসের ৭ হাজার ১১, ২২ মার্চ গাজীপুরের প্রোটেক্স গার্মেন্টসের ৭ হাজার ৫২৭, ১৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফকির ফ্যাশনের ১ লাখ ৪৭, ১৮ এপ্রিল ৫১৬, ১১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের মিক নিটের ২ হাজার ৯৪৭ পিস পোশাক চুরি হয়।
এছাড়া কালিয়াকৈরের করিম টেক্সটাইলের ৪ হাজার ৭১০, ১৫ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জের কায়সার সানকো জেবি টেক্সটাইলের ৩ হাজার, ১৫ মার্চ কালিগঞ্জের কোর স্পান এ্যাপারেলের ১ হাজার ২৩২, ২৩ জুন একই প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ৫০০, ১৪ জুলাই গুডলাক ট্রান্সপোর্ট এন্ড ট্রেডিংয়ের ৪৯৫, ২৫ মে ফ্রেন্ডস লজিস্টিকের ৮৭০, ৮ জুলাই শাহ পরিবহনের ২ লাখ ২৮ হাজার ৮৭২ এবং ৩০ জুন লুফ ফ্রেইট লিমিটেডের ৮ হাজার ৬৭০ পিস পোশাক চুরি হয়েছে।
যেভাবে চুরি হয় পোশাক : পোশাক চুরির সঙ্গে সংঘবদ্ধ চক্র বোকা বানানোর দারুণ একটা ব্যবস্থা তৈরি করেছে। যার ফলে হারানো পণ্য সম্পর্কে ক্রেতারা রপ্তানিকারকদের অবহিত না করা পর্যন্ত তারা সেটা জানতেও পারেন না। কখনো কখনো চালান যাওয়ার কয়েক মাস পর সেটা জানা যায়। যা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক গুণগতমান ও পরিমাণগত নিরীক্ষার পর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পোশাকের চালান পাঠানোর জন্য রপ্তানিকারকরা পরিবহন সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিবহন সংস্থাগুলো তখন লরি ভাড়া করে। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, কারখানায় লোডিং সম্পন্ন হওয়ার পর এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অংশীদার লরি চালকরা চালান, রুট ও সময় সম্পর্কে অন্যদের বার্তা দেন।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা জানান, পরিকল্পনা অনুসারে পণ্যবাহী যান মহাসড়কের কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় থামে। সেখান থেকে তা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, কুমিল্লার চান্দিনা, ফেনী, মিরসরাই ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গোপন গুদামে নেওয়া হয়। সেখানে চক্রগুলো পণ্যবাহী যানের দরজায় লাগানো তালার সিল খুলে ভরা কার্টনের নিচ থেকে কিছু পোশাক বের করে নেয়। পরে খালি অংশ বালু, ন্যাকড়া এমনকি কাদা দিয়ে পূর্ণ করে পুনরায় সিল করে দেওয়া হয়।
এই ধরনের চুরির শিকার বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারক ক্রেতাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন। তারা জানান, পোশাক বের করে নেওয়ার পর সেগুলো আবার এতো সুন্দরভাবে প্যাকেটজাত করা হয় যে, বিদেশি ক্রেতারা কার্টন না খোলা পর্যন্ত কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালানের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পোশাকও চুরি হয়। যা খুব কম দামে স্থানীয় বাজারে কিংবা কিছু অসাধু বিদেশি ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়।
উদ্বেগ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের : মহাসড়কে গার্মেন্টস পণ্য চুরির বিষয়টি রপ্তানিকারকদের কাছে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা—চট্টগ্রাম মহসড়কে পণ্যবাহী লরি থেকে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে এই ধরনের চুরি বেড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানিকারকরা উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে। শিল্প মালিকরা এই ধরনের চুরি প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে মহাসড়কে নজরদারি ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন। কারণ, এতে করে দেশের রপ্তানি আয়ের এই খাতের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে আপস করতে হচ্ছে। প্রতিকার খুঁজতে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠকের বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চুরি ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়ার নিশ্চয়তার পাশাপাশি ৪ মাসের মধ্যে ঢাকা—চট্টগ্রাম মহাসড়কে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর আশ্বাস দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় পুলিশ কারখানা মালিকদের সম্ভব হলে নিজেদের ট্রাকে করে কিংবা পুলিশ প্রহরায় পণ্য পাঠানোর পরামর্শ দেয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্ববাজারে চীনের পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। সে বছর ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের বৈশ্বিক গার্মেন্টস পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ অংশ ছিল ৬.৮ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, বারবার চুরির ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতের সুনাম নষ্ট হতে পারে। ক্রয়াদেশ বাতিল হতে পারে। যার প্রভাব পড়তে পারে দেশের রপ্তানি আয়ের ওপর।

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক পূর্বকোণ

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট