চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

যত্রতত্র ওয়ার্কশপ বন্ধ করলে শহরের যানজট কমবে, বাড়বে সৌন্দর্য

প্রয়োজন স্থায়ী গ্যারেজ টার্মিনাল

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:১৩ অপরাহ্ণ

আবু সাঈদ

অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। সারাদেশের মোটর ওয়ার্কসপ মালিকেরা যখন চরম সংকটের মুখে পড়ে ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১৯৮০ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মোটর ওয়ার্কসপ মালিক সমিতির প্রতিষ্ঠা। যার রেজি. নং- চট্ট ৮৫০/১৯৮০। সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে আবগারি শুল্ক নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামের মোটর ওয়ার্কসপ মালিক শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়।
চট্টগ্রামের এই ক্ষুদ্র সংগঠনটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠে। তখন নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ মোটর ওয়ার্কসপ মালিক সমিতি। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে এই সমিতির সফলতা আসে এবং প্রতিটি জেলায় সংগঠন গড়ে উঠে। দেশব্যাপী সংগঠন করতে হলে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যবাধকতা করা হয়। তখন মোটর ওয়ার্কসপ মালিক সমিতির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওনার্স এসোসিয়েশন নামকরণ করা হয়। যার রেজিস্ট্রেশন নং- ২৩৭ (০৪) ৮৭। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে এই সংগঠনটি চট্টগ্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অটোমোবাইল ওয়ার্কসপগুলি সমস্ত যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করে এই দরিদ্র দেশের পরিবহন ও যানবাহন ব্যবস্থাকে সচল রাখছে। তথা দেশের উন্নয়ন কর্মকাÐে অবদান রাখছে। সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা এই ওয়ার্কসপগুলি দেশের চির অবহেলিত হাজারো শিশু কিশোরদের জীবন গড়ার ইনস্টিটিউশন হিসেবে কাজ করছে। একদিনের চির অবহেলিত শিশু ধীরে ধীরে একজন দক্ষ কারিগর হয়ে বিদেশে চাকুরী করে দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। হাজারো বেকার শিক্ষিত যুবককে চাকুরি দিয়ে এই ওয়ার্কসপগুলি বেকার সমস্যা অনেকাংশে লাঘব করছে। তাই এই ওয়ার্কশপগুলিকে স্থায়ী ভূমি দিয়ে জাতীয় স্বার্থে পুনর্বাসন করা একান্ত প্রয়োজন। সেই দিক দিয়ে আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।
ওয়ার্কশপগুলির মালিক শ্রমিক পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খোলা আকাশের নীচে কাজ করার পর যে মজুরি পায়, তা থেকে যাবতীয় সরকারি কর পরিশোধ করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করছে। বাস ও ট্রাকের জন্য ট্রাক টার্মিনাল, কার, মাইক্রো, টেক্সি ও টেম্পোর জন্য স্টেশন রয়েছে। অথচ সারা দেশের সরকারি/বেসরকারি সমস্ত যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করে পরিবহন ব্যবস্থা যারা সচল রাখে তাদের কোন স্থায়ী ওয়ার্কসপ টার্মিনাল বা স্টেশন বরাদ্দ নাই। তাই চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশের শহরকে সুন্দরভাবে পরিচালনার স্বার্থে যত্রতত্র ওয়ার্কসপ না রেখে তাদেরকে স্থায়ীভাবে জায়গা বরাদ্দ দিয়ে ওয়ার্কসপ টার্মিনাল বা স্টেশন করা যায়। যেমন- চট্টগ্রাম শহরে পতেঙ্গা বিমান বন্দরের কাছে, জেলা ও আন্তঃজেলার গাড়ি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি গেট এলাকায়, অক্সিজেন এলাকায়, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল সংলগ্ন বা কর্ণফুলী সেতু সংলগ্ন এলাকায় ওয়ার্কসপ টার্মিনাল স্থাপন করা আমাদের প্রাণের দাবি। তাই জনস্বার্থে যানবাহন নিরাপদে চলাচল, সুষ্ঠভাবে পরিচালনা, গাড়িসমূহ মেরামতের স্বার্থে চট্টগ্রাম শহরে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় স্থানে ওয়ার্কসপ টার্মিনাল নির্মাণের দাবি জানাই।
শহরে এক হাজারের অধিক মোটর গাড়ির গ্যারেজ আছে। প্রতিটি গ্যারেজে অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করে। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরেই এই খাতের সাথে ৫০ হাজার পরিবার সরাসরি নির্ভরশীল।
স্থায়ী ঠিকানার জন্য সারা বাংলাদেশের জেলা কমিটির কর্মকর্তাদের নিয়ে ১৯৯০ সালের ১ থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ধর্মঘট করি। যার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর, খুলনা বন্দরসহ সারাদেশে যানবাহন অচল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আলোচনায় বসে। সভায় ৭ দফা দাবি নিয়ে আলোচনা হয়। ১৭ জানুয়ারি ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয় । ৭ দফার চুক্তিনামায় ছিল ওয়ার্কসপ প্রতি ৫ কাঠা করে জায়গা বরাদ্দ, সরকারি কাজ করার জন্য সমস্ত মোটর ওয়ার্কশপকে সুযোগ দেয়া এবং ৫৮টি ওয়ার্কসপের একক কাজের আদেশ বাতিল করা, প্রত্যেক ওয়ার্কসপকে কাজ করার সুবিধার্থে ব্যাংক ঋণ দেয়ার শর্ত দেয়া হয়। এছাড়া যাবতীয় যানবাহনের ফিটনেস বেসরকারি খাতে দেয়ার আশ্বাস প্রদান এবং বাকি দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নে রাজি হয় সরকার। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসাইন মো. এরশাদের সভাপতিত্বে ১৯৮৯ সালের ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত সভায় সড়ক পরিবহন নীতির (গ) ধারা মোতাবেক সকল সরকারি বেসরকারি মেরামত কারখানাকে একটি নির্ধারিত স্থানে স্থানান্তর করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মাহামুদুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে এক মতবিনিময় সভা হয়। সভার আলোকে ১৯৯০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ওয়ার্কসপ প্রতি ৫ কাঠা করে জায়গা বরাদ্দ এবং আধুনিক ওয়ার্কসপ টার্মিনাল করার ঘোষণা দেন।
মোটর গাড়ির রেজিস্ট্রেশন জটিলতা, ফিটনেসসহ যাবতীয় যানবাহন মেরামত মোটরগাড়ির গ্যারেজ ওয়ার্কশপগুলির সার্বিক সমস্য সমাধানের লক্ষ্যে গত ২০২১ সালের ২ জুন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর সাথে এক মতবিনিময় সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত সমূহ এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। যা চট্টগ্রামবাসীর জন্য দুঃখ ও বেদনাদায়ক।
চট্টগ্রামের বিসিক অটোমোবাইল শিল্পনগরী চট্টগ্রাম শীর্ষক প্রকল্পটি বিসিকের সবুজ পাতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রজেক্ট প্রোফাইল অনুমোদন হয়ে ১০ একর জায়গার উপর একটি প্রকল্প সংক্রান্ত প্রতিবেদন সহকারী কমিশনার ভূমি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাশক রাজস্ব কর্তৃক অনুমোদন হয়ে ভূমি অধিগ্রহণ প্রাক্কালে হঠাৎ করে চট্টগ্রামবাসীর প্রতি বিমাতাসূলভ আচরণ করে বিসিক চেয়ারম্যান আমাদের প্রকল্পটির যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। যাহা আমাদের জন্য দুঃখ ও বেদনাদায়ক।
২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর ১১ দফা দাবি সম্পর্কিত এক মতবিনিময় সভা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ. ম নাছির উদ্দীনের সাথে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মেয়র সাহেব ঘোষণা করেন সমিতির সনদপত্র কোন ট্রেডলাইসেন্স নতুন বা পুরাতন ইস্যু করা যাবে না। ট্রেড লাইসেন্সবিহীন কোন ব্যবসা করা যাবে না। তার পরেও চট্টগ্রাম শহরে হাজারো প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করছে। সিটি কর্পোরেশন বাস্তব কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যার ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।
সরকারী রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এক মতবিনিময় সভা কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাটের সাতে সৈকত সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। তাও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সাথে সংগঠনের নেতৃবৃন্দের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনিই ঘোষণা করেন যে, ট্রেড লাইসেন্স নাই ব্যবসা নাই। তাও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ চট্টগ্রাম শহরে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স বিহীন ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
পরিশেষে আমাদের দাবি হচ্ছে, ১৯৮০ সাল হতে ২০২১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দুই শতাধিক পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ৪২ বৎসর ধরে এসব চিঠি পাঠানো হয়। যদিও আমাদের অধিকাংশ দাবি পূরণ হয়েছে। আমাদের মূল দাবি ছিল ওয়ার্কসপ প্রতি ৫ কাঠা জমি বরাদ্দ । ১৯৯০ সালের সরকারের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল তা এখানো বাস্তবায়ন হয়নি। তা বাস্তবায়ন করা আমাদের প্রাণের দাবি। তাছাড়াও যত্রতত্র যাবতীয় যানবাহন কাজ করা, ফুটপাত, শপিং কমপ্লেক্স, বিভিন্ন মোটর পার্টেসের দোকানের সামনে গাড়ি কাজ করা বিশেষ করে কর্ণফুলী সেতু সংযোগ সড়ক, মুরাদপুর, আগ্রাবাদসহ ফ্লাইওভারের নিচে ইঞ্জিন খোলা বাঁধাসহ যাবতীয় বে-আইনী ও অবৈধভাবে যত্রতত্র গাড়ির কাজ বন্ধ করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। ফুটপাত সড়কের আশেপাশে ফ্লাইওভারের নিচে দোকানের সামনে যানবাহন মেরামতের কাজ বন্ধ হলে চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসন হবে এবং চট্টগ্রামের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পাবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে কঠোর পপদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
সর্বশেষ আমাদের প্রাণের দাবি দেশের যানবাহন মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান অটোমোবাইল ওয়ার্কসপ মালিক সমিতির জন্য বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকা তথা কর্ণফুলী সেতু সংলগ্ন এলাকায় এবং অক্সিজেন বাস-টার্মিনাল এলাকায়, পতেঙ্গা বন্দর এলাকায় পৃথক পৃথক ওয়ার্কশপ টার্মিনাল এবং জেলা ও আন্ত জেলা সড়ক বিশ্ব রোড এলাকায় একটি ওয়ার্কসপ টার্মিনাল স্থাপন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আকুল আবেদন জানাই।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওনার্স এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম জেলা শাখা

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট